নর্দার্ন ইসলামী ইন্স্যুরেন্সের কোটি কোটি টাকার এজেন্ট কমিশন কার পকেটে!

নিজস্ব প্রতিবেদক: অতিরিক্ত কোন কমিশন দেয়া হয়নি। আবার প্রকৃত এজেন্টদের কমিশন দেয়া হয়েছে এমন তথ্যও নেই। অথচ বছরের পর বছর ধরে এজেন্ট কমিশনের নামে পরিশোধ করা হয়েছে কোটি কোটি টাকা। বিগত ১০ বছরের বিশেষ নিরীক্ষার তথ্য পর্যালোচনা করে নর্দার্ন ইসলামী ইন্স্যুরেন্সের এজেন্টদের কমিশন প্রদানের এই চিত্র পাওয়া গেছে।

পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, যেসব এজেন্টকে কমিশন দেয়া হয়েছে তাদের লাইসেন্স নেই। একাউন্ট পেয়ী চেকের মাধ্যমে কমিশন পরিশোধের বিধান থাকলেও দেয়া হয়েছে নগদে। এজেন্টদের প্রিমিয়াম সংগ্রহের ভিত্তিতে কমিশন দেয়া কথা। অথচ কাকে কত টাকার কমিশন দেয়া হয়েছে সে তথ্যও নেই। এমনকি অনেক এজেন্টের নামে নেই ব্যাংক একাউন্ট, নেই তাদের জাতীয় পরিচয়পত্রও।

ফলে বছরের পর বছর ধরে নর্দার্ন ইসলামী ইন্স্যুরেন্স এজেন্ট কমিশন পরিশোধের যে হিসাব দিচ্ছে তা প্রকৃতপক্ষে এজেন্টদের দেয়া হয়েছে কিনা তা নিশ্চিত হতে পারেনি বীমা কোম্পানিটিতে দফায় দফায় নিয়োগ দেয়া বিশেষ নিরীক্ষক দল। ইন্স্যুরেন্স নিউজ বিডি’র অনুসন্ধানে এমন চিত্র উঠে এসেছে।

অনুসন্ধানে দেখা যায়, ২০১৯ সালের আগস্ট থেকে ২০২১ সালের মে পর্যন্ত নর্দার্ন ইসলামী ইন্স্যুরেন্সের ৯টি বিষয়ে তদন্তের জন্য বিশেষ নিরীক্ষক নিয়োগ করে বীমা খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থা আইডিআরএ। এই নিরীক্ষক নিয়োগ করা হয় ২০২১ সালের ১ জুন।

এই ৯টি বিষয়ে নিরীক্ষার মধ্যে একটি ছিল এজেন্ট ও উন্নয়ন কর্মকর্তাগণের প্রদত্ত কমিশন, বেতন-ভাতাদি, অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা আইন ও বিধি-বিধান অনুসরণ করে পরিশোধ করে করা হয়েছে কিনা তা যাচাই করা।

আলোচ্য সময়ে নিরীক্ষা করে চার্টার্ড একাউন্ট ফার্ম জি কিবরিয়া এন্ড কোং তার প্রতিবেদনে কমিশন প্রদানের বিষয়ে যেসব অনিয়মের তথ্য তুলে ধরে তার মধ্যে রয়েছে- এজেন্ট কমিশন দেয়া হয়েছে একাউন্ট পেয়ী চেক ছাড়াই। কমিশনের এই টাকা তোলা হয়েছে ক্যাশ বা নগদে। এজেন্টদের কাকে কত টাকা দেয়া হয়েছে তারও কোন হিসাব নেই।

নিরীক্ষকরা বলছে, ২০২০ সালে ৪৪ জন এজেন্টের নামে কমিশন দেয়া হয়েছে, যার মধ্যে ২২ জনেরই হালনাগাদ এজেন্ট লাইসেন্স নেই। আবার ২০২০ সালে কমিশন পরিশোধ দেখানো হয়েছে ১৩ কোটি ৭৪ লাখ টাকা। এর মধ্যে ৯ কোটি ৯০ লাখ টাকা পরিশোধ করা হয়েছে ৪৪ জন এজেন্টের নামে। বাকী টাকা কাকে দেয়া হয়েছে তার কোন হদিস নেই।

অপরদিকে ২০২২ সালে নিরীক্ষা করে আশরাফ উদ্দিন এন্ড কোং। প্রতিষ্ঠানটির নিরীক্ষা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০২২ সালে কোম্পানিটিতে মোট এজেন্ট ছিল ৪১ জন। এসব এজেন্টের নামে মোট কমিশন প্রদান করা হয় ১৫ কোটি ৬ লাখ টাকা।

তবে নিরীক্ষা দল বলছে, আইডিআরএর নির্দেশনা লঙ্ঘন করে ব্যাংকিং চ্যানেলের বাইরে তিন কর্মকর্তার নামে ৮২.৫৩ লাখ টাকার কমিশন দিয়েছে নর্দার্ন ইসলামী ইন্স্যুরেন্স।

এসব কর্মকর্তার কোন ব্যাংক একাউন্ট নেই এবং কোম্পানির ব্যাংক স্টেটমেন্টেও তাদের কমিশন প্রদানের কোন তথ্য নেই। অবৈধভাবে এই বিপুল অংকের কমিশন দেয়া হয়েছে বলে মন্তব্য করেছে তদন্ত দল।

এর আগে ২০১৩, ২০১৪ ও ২০১৫ সালেও নর্দার্ন ইসলামী ইন্স্যুরেন্সে বিশেষ নিরীক্ষা পরিচালনা করে আইডিআরএ। তিনটি নিরীক্ষা কার্যক্রম-ই সম্পন্ন করে চার্টার্ড একান্টেন্ট ফার্ম মসিহ মুহিত হক এন্ড কোং।

নিরীক্ষা প্রতিবেদনের তথ্য অনুসারে, ২০১৩ সালে ১০৫ জনকে, ২০১৪ সালে ৪৭ জনকে এবং ২০১৫ সালে ৪৫ জনকে মোট ১১ কোটি ১৭ লাখ ৩৬ হাজার টাকার এজেন্ট কমিশন দেয় নর্দার্ন ইসলামী ইন্স্যুরেন্স।

কমিশনের এই টাকা আইন অনুসারে প্রকৃত এজেন্টেদের প্রদান করেছে কিনা তা যাচাই করে নিরীক্ষা প্রতিষ্ঠান।

এতে দেখা যায়, ওই তিন বছরে কোম্পানিটির কোন এজেন্টের-ই লাইসেন্সের মেয়াদ ছিল না। এর মধ্যে ২০১৩ সালে কমিশন পাওয়া ১২ জন এজেন্টের ব্যাংক একাউন্ট ছিল না। আর জাতীয় পরিচয়পত্র ছিল না ২০১৩ সালে ২৯ জন এবং ২০১৪ ও ২০১৫ সালে ৬ জনের।

বিশেষ নিরীক্ষক দল নমুনা হিসেবে ২০১৩ সালের ১ কোটি ৫০ লাখ টাকা, ২০১৪ সালের ১ কোটি ৪৫ লাখ টাকা এবং ২০১৫ সালের ৭১ লাখ টাকা এজেন্ট কমিশন প্রদান সংশ্লিষ্ট নথিপত্র চায় নর্দার্ন ইসলামী ইন্স্যুরেন্সে কাছে।

তবে বীমা কোম্পানিটি ২০১৩ সালের ৫৫ লাখ ৭৯ হাজার টাকা, ২০১৪ সালে ৭২ লাখ ৩০ হাজার টাকা এবং ২০১৫ সালের ২৯ লাখ ৫৫ হাজার টাকার কমিশন কাকে এবং কি হিসেবে প্রদান করেছে তার কোন তথ্য-ই দিতে পারেনি নিরীক্ষক দলকে।

এ ছাড়াও ২০১৩ সালের ৩১ লাখ ৭৪ হাজার টাকা, ২০১৪ সালে ৩৮ লাখ ২৫ হাজার টাকা এবং ২০১৫ সালের ৬১ হাজার টাকা কমিশনের পেমেন্ট ভাউচার ছাড়া আর কোন তথ্য দিতে পারেনি বীমা কোম্পানিটি।

বিশেষ নিরীক্ষকের প্রতিবেদনেও গোঁজামিলের তথ্য

কোম্পানির অনিয়ম-দুর্নীতি খুঁজতে এবং আয়-ব্যয়ের হিসাবের সঠিকতা যাচাইয়ের জন্য নিয়ন্ত্রক সংস্থা থেকে নিয়োগ দেয়া হয় বিশেষ নিরীক্ষক। অথচ সেই নিরীক্ষকা প্রতিবেদনের হিসাবেই গোঁজামিল দিয়েছে নিরীক্ষক। নর্দার্ন ইসলামী ইন্স্যুরেন্সের বিশেষ নিরীক্ষাতে এমন গোঁজামিলের তথ্য দিয়েছে নিরীক্ষা প্রতিষ্ঠান জি কিবরিয়া এন্ড কোং। আগস্ট ২০১৯ থেকে মে ২০২১ সালের ওপর এই নিরীক্ষা প্রতিবেদন প্রস্তুত করা হয়েছে।

প্রতিবেদনের ১৬ নম্বর পৃষ্ঠায় এজেন্ট কমিশন সংক্রান্ত হিসাবে দেখানো হয়েছে, ২০২০ সালে মোট এজেন্ট কমিশন দেয়া হয়েছে ১৩ কোটি ৭৫ লাখ টাকা অথচ এনেক্সার ‘সি’তে এর বিস্তারিত তথ্যে এই কমিশনের পরিমাণ দেখানো হয়েছে ৯ কোটি ৯০ লাখ টাকা। এক্ষেত্রে হিসাবের গড়মিল হয়েছে ৩ কোটি ৮৫ লাখ টাকা।

আবার ২০২১ সালের হিসাবে ওই বছরের জুন পর্যন্ত ৬ মাসে মোট কমিশন খরচ দেখানো হয়েছে ২ কোটি ৪৯ লাখ টাকা। অথচ এ সংক্রান্ত বিস্তারিত তথ্য এনেক্সার ‘সি’তে ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ২ মাসে কমিশন দেখানো হয়েছে ২ কোটি ৫৪ লাখ টাকা। এক্ষেত্রে বছরের প্রথম ২ মাসে যে খরচ দেখানো হয়েছে তার চেয়ে ৫ লাখ টাকা কম দেখানো হয়েছে ওই বছরের প্রথম ৬ মাসের কমিশন খরচ।

তবে বিশেষ নিরীক্ষা প্রতিবেদনের এসব গড়মিল হিসাবের বিষয়ে নিরীক্ষা প্রতিষ্ঠান জি কিবরিয়া এন্ড কোং এর বক্তব্য নেয়া সম্ভব হয়নি।

অপরদিকে বিশেষ নিরীক্ষা প্রতিবেদনে উত্থাপিত অনিয়ম-আপত্তির বিষয়ে নর্দার্ন ইসলামী ইন্স্যুরেন্স কোম্পানির এসিসট্যান্ট ভাইস-প্রেসিডেন্ট (অর্থ ও হিসাব) বিদ্যুৎ কুমার সমাদ্দার বলেন, বিশেষ নিরীক্ষা প্রতিবেদনে উত্থাপিত সকল অভিযোগ নিষ্পত্তি করা হয়েছে। এসব বিষয়ে আমাদের নতুন করে কিছু বলার নেই। যা বলার তা আইডিআরএ’কে লিখিভাবেই জানানো হয়েছে।

এ বিষয়ে আইডিআরএ’র উপ-পরিচালক ও মুখপাত্র মো. সোলায়মান বলেন, বিশেষ নিরীক্ষা প্রতিবেদনগুলোর ক্ষেত্রে কর্তৃপক্ষের টার্মস অব রেফারেন্স (টিওআর) অনুযায়ী প্রতিটি অনিয়মের জন্য কোম্পানিগুলোকে জরিমানা করা হয়েছে এবং হচ্ছে। এসব বিষয়ে এখনো কাজ চলছে, অপরাধ অনুসারে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবে কর্তৃপক্ষ।

এ ছাড়াও বিশেষ নিরীক্ষা প্রতিবেদনে গড়মিল হিসাবের বিষয়টি কর্তৃপক্ষের নজরে এনে সংশ্লিষ্ট নিরীক্ষকদের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে বলেও জানান আইডিআরএ’র উপ-পরিচালক ও মুখপাত্র মো. সোলায়মান।