প্যারামাউন্ট ইন্স্যুরেন্সের বীমা ব্যবসা

স্বামীরা ডিএমডি-ডিজিএম, স্ত্রীরা এজেন্ট

নিজস্ব প্রতিবেদক: সারওয়ার খান, প্যারামাউন্ট ইন্স্যুরেন্সের একজন ডিএমডি এবং মার্কেটিং বিভাগের প্রধান। বীমা কোম্পানিটির সম্পূর্ণ মার্কেটিং ও ডেভেলপমেন্ট বিভাগ নিয়ন্ত্রণ করেন তিনি।

সারওয়ার খানের স্ত্রী মারিয়া সুলতানা খান একজন বীমা এজেন্ট। প্যারামাউন্ট ইন্স্যুরেন্সের প্রধান কার্যালয়ের অধীনে তিনি বীমা এজেন্ট হিসেবে কাজ করেন।

মারিয়া সুলতানার নামে ২০১৯ সালের আগস্ট থেকে ২০২০ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত প্যারামাউন্ট ইন্স্যুরেন্স থেকে ৩ লাখ ৯৫ হাজার ৪শ’ টাকার নেট এজেন্ট কমিশন প্রদান করা হয়েছে।

প্যারামাউন্ট ইন্স্যুরেন্সের হিসাব বিভাগের ডিজিএম সৈয়দ কবির হোসেনের স্ত্রী নাসরিন ভূঁইয়াও একজন বীমা এজেন্ট এবং কোম্পানিটির প্রধান কার্যালয়ের অধীনে কাজ করেন। নাসরিন ভূঁইয়ার নামেও বীমা কোম্পানিটি থেকে নেট এজেন্ট কমিশন প্রদান করা হয়েছে ১০ লাখ ৯৯ হাজার টাকা।

শুধু মারিয়া সুলতানা বা নাসরিন ভূঁইয়া নয়, এমন ৯জন নারী এজেন্ট রয়েছে প্যারামাউন্ট ইন্স্যুরেন্সে; যাদের স্বামীরা বীমা কোম্পানিটির প্রধান কার্যালয়সহ সংশ্লিষ্ট ব্রাঞ্চে ডিএমডি, ডিজিএম বা সিনিয়র পদে কর্মরত।  এই ৯ জন বীমা এজেন্টকে মোট ৫৬ লাখ ৩০ হাজার ৬শ’ টাকার কমিশন প্রদান করা হয়েছে।

এছাড়াও এমন ২ জন বীমা এজেন্ট রয়েছে প্যারামাউন্ট ইন্স্যুরেন্সে, যারা কোম্পানিটির একই ব্রাঞ্চে কর্মকর্তা হিসেবেও নিয়মিত বেতন-ভাতা গ্রহণ করছেন। এই দু’জনকে নির্ধারিত বেতন-ভাতার পাশাপাশি এজেন্ট কমিশন বাবদ প্রদান করা হয়েছে ১১ লাখ ৮৪ হাজার ৪শ’ টাকা।

প্যারামাউন্ট ইন্স্যুরেন্সের এজেন্ট সংক্রান্ত এমন তথ্য উঠে এসেছে নিয়ন্ত্রক সংস্থা আইডিআরএ’র তদন্ত প্রতিবেদনে। কোম্পানিটিতে ২০১৯ সালের আগস্ট থেকে ২০২০ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত এই তদন্ত করা হয় বীমা আইন ২০১০ এর ৪৮ ধারার অধীনে। চার্টার্ড একাউন্টেন্টস ফার্ম শফিক মিজান রহমান এন্ড অগাস্টিন ছিল তদন্তকারী।

বীমা আইনে কর্মকর্তাদের স্ত্রী, ছেলে-মেয়ে বা পরিবারের সদস্যরা বীমা এজেন্ট হতে পারবে না- এমন কোন আইনি নিষেধাজ্ঞা নেই। তবে বীমা খাত সংশ্লিষ্টা বলছেন- এটি দৃষ্টিকটু।

এ বিষয় নিয়ে বীমা খাত সংশ্লিষ্টদের সাথে আলাপ করে ইন্স্যুরেন্স নিউজ বিডি। ওই আলোচনায় জানা যায়, নন-লাইফ বীমা খাতে পেশাদার এজেন্ট নেই। বীমা কোম্পানিগুলোতে উন্নয়ন কর্মকর্তা বা ডেভেলপমেন্ট অফিসার নিয়োগ করে। কোন কোন সময় তাদের মার্কেটিং অফিসার বলা হয়।

এই মার্কেটিং অফিসাররা মূলত পলিসি বিক্রি করে বা বীমার প্রিমিয়াম সংগ্রহ করে। মার্কেটিং অফিসাররা বেতনভুক্ত; তাদেরকে প্রিমিয়াম সংগ্রহের টার্গেট ভিত্তিক বেতন নির্ধারণ করা হয়। এই টার্গেট ভিত্তিক বেতনভুক্ত কর্মকর্তারা তাদের পরিবারের সদস্যদের এজেন্ট হিসেবে নিয়োগ করে কমিশনের টাকা নিয়ন্ত্রণের জন্য।

তারা কমিশনের উপর এই নিয়ন্ত্রণটি করেন মূলত কমিশনের টাকা তুলে গ্রাহককে দেয়া জন্য বা অবৈধভাবে কমিশন দেয়ার জন্য। আবার এমন অভিযোগও আছে কমিশনের টাকা গ্রাহককে দেয়ার কথা বলে তা না দিয়ে সেই সুবিধা নিজেই নেন।

আরো জানা যায়, বীমা খাতে আইন অনুসারে ১৫ শতাংশ কমিশন দিতে পারে। কিন্তু বীমা কোম্পানিগুলো আর্থিক প্রতিবেদনে ১৫ শতাংশ কমিশন দেখালেও তা ৬০ শতাংশ পর্যন্ত দেয়া হয়। পরিবারের সদস্যদের নামে এজেন্ট লাইসেন্স দেখিয়ে কমিশন তুলে তা দেয়া হয় গ্রাহকদের।

এক্ষেত্রে কর্মকর্তাদের পরিবারের সদস্যদের নামে মোটা অংকের কমিশন দেয়া হলেও সেখানে মানিল্ডানিং হচ্ছে কিনা তা ক্ষতিয়ে দেখতে কোন উদ্যোগ নেয়া হয়নি। এমনকি খাতটিতে অবৈধ কমিশন বন্ধে কমিশন হার শূন্য শতাংশে নামিয়ে আনার সিদ্ধান্ত নেয়া হলেও বন্ধ করা হয়নি পরিবারের সদস্যদের এজেন্ট নিয়োগ।

খাত সংশ্লিষ্ট বলছেন, কর্মকর্তাদের পরিবারের সদস্যদের এজেন্ট না করার আইন করার পাশাপাশি কর্মকর্তাদের স্ত্রীদের নামে যে মোটা অংকের কমিশন দেখানো হয়েছে তা তাদের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ কিনা এবং মানিলন্ডারিং বা অর্থ পাচারের কোন ঘটনা এক্ষেত্রে ঘটেছে কিনা তা ক্ষতিয়ে দেখতে অধিকতর তদন্ত প্রয়োজন।  

এ বিষয়ে জোরালো পদক্ষেপ নিলে নন-লাইফ বীমা খাতে অবৈধ কমিশন বন্ধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে বলে মনে করছে খাত সংশ্লিষ্টরা। এ ছাড়াও অবৈধ কমিশন চালু থাকার কারণে দেশের বীমা খাতে দক্ষ জনবল তৈরি হচ্ছে না বলেও মনে করেন তারা। তাই নন-লাইফ বীমা খাতে এই ধরণের চর্চা বন্ধে কঠোর পদক্ষেপ নেয়া উচিত আইডিআরএ’র।

প্রতিবেদনের তথ্য অনুসারে, প্যারামাউন্ট ইন্স্যুরেন্সে আইডিআরএ’র লাইসেন্সধারী এজেন্ট রয়েছে মোট ৩০ জন। যারা বীমা কোম্পানিটির প্রধান কার্যালয়সহ দেশজুড়ে থাকা বিভিন্ন ব্রাঞ্চ অফিসের অধীনে কর্মরত। এর মধ্যে প্রধান কার্যালয়ের দু’জনসহ পাঁচটি ব্রাঞ্চে মোট ৯ জন নারী এজেন্টের স্বামী কোম্পানিটির বিভিন্ন সিনিয়র পদে কর্মরত।

এসব এজেন্টের মধ্যে রয়েছেন প্রধান কার্যালয়ের ডিএমডি (মার্কেটিং) সারওয়ার খানের স্ত্রী মারিয়া সুলতানা খান ও ডিজিএম (একাউন্টস) সৈয়দ কবির হোসেনের স্ত্রী নাসরিন ভূঁইয়া। মারিয়া সুলতানা খানকে ২০১৯ সালের আগস্ট থেকে ২০২০ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত নেট এজেন্ট কমিশন দেয়া হয়েছে ৩ লাখ ৯৫ হাজার ৪শ’ টাকা এবং নাসরিন ভূঁইয়াকে দেয়া হয়েছে ১০ লাখ ৯৯ হাজার টাকা।

কাওরান বাজার ব্রাঞ্চের ভিপি (মার্কেটিং) শামসুল আলমের স্ত্রী ফারজানা ইয়াসমিনকে নেট এজেন্ট কমিশন দেয়া হয়েছে ১৩ লাখ ২০ হাজার টাকা এবং একই ব্রাঞ্চের ভিপি (মার্কেটিং) রাশেদুল হাসানের স্ত্রী মমতাজ আফরোজকে নেট এজেন্ট কমিশন দেয়া হয়েছে ৫ লাখ ৫৩ হাজার ৮ শ’ টাকা।

বগুড়া ব্রাঞ্চের এসভিপি এন্ড ইনচার্জ আবদুল হাই এর স্ত্রী মাহমুদা পারভীনকে নেট এজেন্ট কমিশন দেয়া হয়েছে ৬ লাখ ৪৮ হাজার ৫শ’ টাকা এবং একই ব্রাঞ্চের এসভিপি (মার্কেটিং) আশরাফ আলী মিয়ার স্ত্রী সৌরভী শিরিন আশরাফীকে নেট এজেন্ট কমিশন দেয়া হয়েছে ৫ লাখ ৫১ হাজার ৪শ’ টাকা।

কুষ্টিয়া ব্রাঞ্চের ভিপি (মার্কেটিং) আসের আলীর স্ত্রী নুরুন নাহার বেগমকে নেট এজেন্ট কমিশন দেয়া হয়েছে ৪ লাখ ৩৬ হাজার ৭শ’ টাকা, যশোর ব্রাঞ্চের এভিপি (মার্কেটিং) মোহাম্মদ উল্লাহর স্ত্রী শামীমা বেগমকে কমিশন দেয়া হয়েছে ১ লাখ ৭৬ হাজার ৩শ’ টাকা এবং নওগাঁ ব্রাঞ্চের এভিপি (মার্কেটিং) আজিজুল ইসলামের স্ত্রী সুরাইয়া আকতার (সুমী)’কে দেয়া হয়েছে ৪ লাখ ৪৯ হাজার ৫শ’ টাকা।

এ ছাড়াও প্যারামাউন্ট ইন্স্যুরেন্সের আগ্রাবাদ ব্রাঞ্চের কর্মকতা হুমায়ুন রশিদ চৌধুরীকে একই ব্রাঞ্চের বীমা এজেন্ট হিসেবে নেট কমিশন প্রদান করা হয়েছে ১১ লাখ ২৫ হাজার টাকা এবং সৈয়দ হাসান মাহমুদকে নির্ধারিত বেতন-ভাতা পরিশোধের পাশাপাশি এজেন্ট কমিশন বাবদ প্রদান করা হয়েছে ৫৯ হাজার ৪শ’ টাকা।

এদিকে তদন্তকালে বীমা কোম্পানিটির লাইসেন্সধারী ৩০ জন বীমা এজেন্টের কমিশন গ্রহণ সংক্রান্ত ব্যাংক হিসাবের তথ্য (স্টেটমেন্ট) তলব করলেও ৭জন এজেন্ট তাদের ব্যাংক হিসাবের তথ্য তদন্ত কর্মকর্তাদের কাছে দাখিল করেননি। এজেন্ট কমিশন গ্রহণ সংক্রান্ত ব্যাংক হিসাবের তথ্য দিতে না চাওয়া বীমা এজেন্টরা হলেন-

কোম্পানিটির ডিএমডি (মার্কেটিং) সারওয়ার খানের স্ত্রী মারিয়া সুলতানা খান, কাওরান বাজার ব্রাঞ্চের ভিপি (মার্কেটিং) শামসুল আলমের স্ত্রী ফারজানা ইয়াসমিন, বগুড়া ব্রাঞ্চের এসভিপি এন্ড ইনচার্জ আবদুল হাই এর স্ত্রী মাহমুদা পারভীন এবং আগ্রাবাদ ব্রাঞ্চের কর্মকতা ও কোম্পানিটির একই ব্রাঞ্চের বীমা এজেন্ট সৈয়দ হাসান মাহমুদ।

এ ছাড়াও বীমা কোম্পানিটির প্রধান কার্যালয়ের অধীনে কর্মরত নাজমা আখতার, মো. শহিদ উল্লাহ এবং মো. জাহিদুল ইসলাম খান নামের ৩ জন বীমা এজেন্ট তাদের কমিশন গ্রহণ সংক্রান্ত ব্যাংক হিসাবের তথ্য বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের নিযুক্ত তদন্ত দলের কাছে দাখিল করেননি।

নিরীক্ষা প্রতিবেদনের তথ্য অনুসারে, ২০১৯ সালের ১ আগস্ট থেকে ২০২০ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত কোম্পানিটির প্রধান কার্যালয়সহ ১১টি ব্রাঞ্চে কমিশন বাবদ খরচ করা হয়েছে ৩ কোটি ৫১ লাখ ৫৮ হাজার টাকা। এর মধ্যে প্রধান কার্যালয় থেকে কমিশন দেয়া হয়েছে ২ কোটি ১৯ লাখ ৮ হাজার টাকা, যা কোম্পানিটির মোট কমিশনের ৬২ শতাংশ।

এসব বিষয়ে বক্তব্য জানতে প্যারামাউন্ট ইন্স্যুরেন্স পিএলসি’র মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা সাজ্জাদ ইয়াহিয়ার সাথে যোগাযোগ করে ইন্স্যুরেন্স নিউজ বিডি। তবে তিনি অসুস্থ থাকায় বিষয়টি নিয়ে কোম্পানি সেক্রেটারি এন্ড হেড অব এডমিন, এইচআর ঝর্ণা পারুলের সঙ্গে কথা বলতে বলেন।

ঝর্ণা পারুল ইন্স্যুরেন্স নিউজ বিডি’কে বলেন, বিষয়টি বহু আগের এবং মীমাংসিত বিষয়। বিশেষ নিরীক্ষার পর বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ বিষয়টি নিয়ে আমাদের শুনানিতে ডেকেছিল। আমাদের পক্ষ থেকে বক্তব্য শোনার পর কর্তৃপক্ষ বিষয়টি ছাড় দিয়েছে। মীমাংসিত এই বিষয় নিয়ে আর কিছু বলার প্রয়োজন আছে বলে মনে হয় না।

এ বিষয়ে আইডিআরএ’র পরামর্শক (মিডিয়া এবং যোগাযোগ) সাইফুন্নাহার সুমি বলেন, বিশেষ নিরীক্ষায় উত্থাপিত আপত্তির বিষয়টি ঘটেছিল মূলত বীমা এজেন্ট নিয়োগ সংক্রান্ত প্রবিধানমালা হওয়া আগে। তাই এ বিষয়ে শুনানির সময় কর্তৃপক্ষ প্যারামাউন্ট ইন্স্যুরেন্স কোম্পানিকে সতর্ক করেছিল। একইসাথে কোম্পানিটিকে বীমা এজেন্ট নিয়োগের প্রবিধানমালা যথাযথভাবে পরিপালনের নির্দেশনা প্রদান করেছিল।