প্রস্তাবিত ব্যবস্থাপনা ব্যয়সীমা নিয়ে মুখ্য নির্বাহীদের প্রতিক্রিয়া

বীমা পরিকল্প রিভিউ ও কমিশন সিডিউল পুনর্নির্ধারণের পর ব্যয়সীমা কমানোর দাবি লাইফ বীমায়

আবদুর রহমান আবির: দেশের লাইফ বীমা কোম্পানির জন্য ব্যবস্থাপনা ব্যয় সীমা পুনর্নিধারণে খসড়া প্রস্তাবনা প্রকাশ করেছে বীমা খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থা আইডিআরএ। এই প্রস্তাবে বীমা পলিসির ধরণের ওপর ভিত্তি করে ব্যয় সীমা ১% থেকে ১৫% পর্যন্ত কমানোর কথা বলা হয়েছে। তবে ব্যবস্থাপনা ব্যয়ের প্রস্তাবিত সীমা নিয়ে লাইফ বীমা কোম্পানিগুলোর মধ্যে উদ্বেগ সৃষ্টি হয়েছে।

খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বর্তমানে প্রায় ২০টি লাইফ বীমা কোম্পানি নির্ধারিত ব্যয় সীমার তুলনায় অতিরিক্ত খরচ করছে। এসব কোম্পানিকে নির্দিষ্ট সময় দিয়ে ধাপে ধাপে প্রচলিত সীমার মধ্যে আনা সম্ভব। কিন্তু ব্যয় সীমা হঠাৎ কমিয়ে দিলে তা পুরো খাতকে অস্থিতিশীল করে তুলবে। যেসব কোম্পানি অনুমোদিত সীমার কাছাকাছি ব্যয় করছে তারাও অতিরিক্ত ব্যয়ের কোম্পানিতে পরিণত হবে।

এক্ষেত্রে বর্তমান ব্যবস্থাপনা ব্যয়ের সীমা আরো কয়েক বছর বহাল রেখে ধাপে ধাপে সংস্কার কার্যক্রম চালানোর পরামর্শ দিচ্ছেন খাত সংশ্লিষ্টরা তাদের মতে, দেশের লাইফ বীমা পরিকল্পগুলো রিভিউ করার পাশাপাশি কমিশন সিডিউল পুনর্নির্ধারণ করা প্রয়োজন। একইসঙ্গে ব্যবস্থাপনা ব্যয়ের হার কতটুকু কমানো হবে তা স্টেকহোল্ডারদের সাথে বসে যাচাই-পর্যালোচনা করে নির্ধারণ করতে হবে।

আইডিআরএ’র প্রস্তাবিত সংশোধন অনুসারে, লাইফ বীমা কোম্পানির ব্যবসার সময়কাল বা বয়স যদি ১০ বছর বা তদুর্ধ্ব হয় তাহলে ১০০ কোটি টাকা পর্যন্ত প্রথম বর্ষ মোট প্রিমিয়ামের ৮২ শতাংশ খরচ করতে পারবে। তবে বিদ্যমান প্রবিধানমালায় এই খরচের সীমা ৯৩ শতাংশ। অর্থাৎ প্রস্তাবিত সংশোধনী কার্যকর হলে এই ব্যয়সীমা কমবে ১১ শতাংশ।

এ ছাড়াও নবায়ন প্রিমিয়ামের ক্ষেত্রে ১০ বছর বা তদুর্ধ্ব বয়সের কোম্পানির জন্য সকল অবস্থায় সর্বোচ্চ ১০ শতাংশ ব্যয়সীমা প্রস্তাব করা হয়েছে খসড়া প্রজ্ঞাপনে। বিদ্যমান প্রবিধানমালায় এই খরচের সীমা ২০ শতাংশ পর্যন্ত নির্ধারণ করা আছে। এক্ষেত্রেও কোম্পানিগুলোর ১০ শতাংশ পর্যন্ত খরচ কমবে।

খসড়া প্রজ্ঞাপনের তথ্য মতে, অ্যানুয়িটি পলিসির ক্ষেত্রে একক প্রিমিয়াম পদ্ধতিতে প্রিমিয়াম আদায় করা হলে প্রথম বছরে আদায়কৃত প্রিমিয়ামের ৪ শতাংশ খরচ করা যাবে। কিস্তিতে প্রিমিয়াম আদায় করা হলে প্রথম বছরে আদায়কৃত প্রিমিয়ামের ৭ শতাংশ এবং নবায়নের ৪ শতাংশ খরচ করা যাবে। আর উভয় ক্ষেত্রেই সংশ্লিষ্ট বছরে পরিশোধিত মোট অ্যানুয়িটির ১ শতাংশ ব্যবস্থাপনা খাতে ব্যয় করা যাবে। তবে একক প্রিমিয়াম পলিসির ক্ষেত্রে খরচ করা যাবে আদায়কৃত প্রিমিয়ামের ৫ শতাংশ পর্যন্ত।

অপরদিকে পেইড আপ পলিসি’র ক্ষেত্রে মোট বীমা অংকের বাৎসরিক গড়ের (পুনর্বীমা বাদে) ০.০৫ শতাংশ খরচ করা যাবে। আর গোষ্ঠী বীমা পলিসির ক্ষেত্রে ব্যবস্থাপনা ব্যয় করা যাবে বৎসরে পরিশোধিত প্রিমিয়ামের ১০ শতাংশ।

দফা (১), (২) ও (৩) ব্যতীত অন্যান্য সকল পলিসির ক্ষেত্রে লাইফ বীমাকারীর ব্যবসার সময়কাল বা বয়স- ১ থেকে ৫ বছর হলে প্রথম বর্ষ প্রিমিয়ামের ৮৫ শতাংশ এবং নবায়ন প্রিমিয়ামের ক্ষেত্রে ২০ শতাংশ খরচ করা যাবে। আর ব্যবসার সময়কাল বা বয়স- ৬ থেকে ১০ বছর হলে প্রথম বর্ষ প্রিমিয়ামের ৮৪ শতাংশ এবং নবায়ন প্রিমিয়ামের ক্ষেত্রে ১৭ শতাংশ ব্যয় করা যাবে ব্যবস্থাপনা খাতে।

লাইফ বীমা কোম্পানির ব্যবসার সময়কাল বা বয়স যদি ১০ বছর বা তদুর্ধ্ব হয় তাহলে প্রথম বর্ষ মোট প্রিমিয়ামের প্রথম ১০০ কোটি টাকা পর্যন্ত ৮২ শতাংশ খরচ করতে পারবে। আর ১০০ কোটি টাকার বেশি কিন্তু অনূর্ধ্ব ৫০০ কোটি টাকা হলে ৮১ শতাংশ এবং ৫০০ কোটি টাকার বেশি হলে ৭৬ শতাংশ খরচ করতে পারবে। তবে নবায়ন প্রিমিয়ামের ক্ষেত্রে ১০ বছর বা তদুর্ধ্ব বয়সের কোম্পানির জন্য সকল অবস্থায় সর্বোচ্চ ১০ শতাংশ ব্যয়সীমা প্রস্তাব করা হয়েছে।

এ বিষয়ে মুখ্য নির্বাহীদের সংগঠন বাংলাদেশ ইন্স্যুরেন্স ফোরাম (বিআইএফ)’র জয়েন্ট সেক্রেটারি জেনারেল ও জেনিথ ইসলামী লাইফের মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা এস এম নুরুজ্জামান বলেন, বর্তমানে প্রচলিত ব্যয় সীমা বজায় রাখাই একটি বড় চ্যালেঞ্জ। এ অবস্থায় প্রস্তাবিত হ্রাস কার্যকর হলে বিশেষ করে নতুন প্রজন্মের কোম্পানিগুলো মারাত্মক চাপে পড়বে।

তিনি আরও বলেন, গোষ্ঠী বীমার ব্যয়সীমা ৫% কমানোর প্রস্তাব বাস্তবায়িত হলে কর্মীরা গোষ্ঠী বীমা বিক্রয়ে নিরুৎসাহিত হবেন। এর ফলে বিপুল জনগোষ্ঠী বীমার আওতার বাইরে থেকে যাবে এবং জাতীয় বীমা সম্প্রসারণ কার্যক্রমে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে।

প্রথম বর্ষ প্রিমিয়াম আয়ের ব্যয়সীমা ১১% হ্রাসের প্রস্তাব নিয়েও তিনি শঙ্কা প্রকাশ করেছেন। তার মতে, বিদ্যমান সীমা বজায় রাখাই কঠিন। সেখানে অতিরিক্ত ১১% হ্রাস হলে কর্মীরা বীমা সংগ্রহে আগ্রহ হারাবেন। এতে কর্মসংস্থান সংকুচিত হবে এবং বীমার ঘনত্বও হ্রাস পাবে।

এ ছাড়া নবায়ন প্রিমিয়ামের ব্যয়সীমা ৫% কমানোর প্রস্তাবকে তিনি বাস্তবতার সঙ্গে অসামঞ্জস্যপূর্ণ উল্লেখ করেন। তার ভাষায়, নবায়ন প্রিমিয়ামে কমিশন তুলনামূলক কম হওয়ায় এ খাতে কর্মীদের আগ্রহ আগে থেকেই সীমিত। এই সীমা আরও কমালে পলিসি ল্যাপস বৃদ্ধির পাশাপাশি কোম্পানির ধারাবাহিক আয় ও আর্থিক স্থিতিশীলতা ব্যাহত হবে।

শুধু এস এম নুরুজ্জামান নন, অন্যান্য বীমা কোম্পানির মুখ্য নির্বাহীরাও একই ধরনের প্রতিক্রিয়ায় ব্যক্ত করেছেন। তাদের মতে- প্রস্তাবিত ব্যয়সীমা হ্রাস বাস্তবায়ন হলে এ খাতের নতুন কোম্পানিগুলোর টিকে থাকা কঠিন হয়ে যাবে। এজেন্টদের আয়ের সুযোগ কমে যাবে। দক্ষ জনবল বীমা খাত থেকে সরে যেতে পারে। আর সাধারণ গ্রাহক বীমার প্রতি অনাগ্রহী হয়ে পড়বেন।

প্রগতি লাইফ ইন্স্যুরেন্সের মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা মো. জালালুল আজিম বলেন, বেশ কয়েক বছর আগে অনেক আলাপ-আলোচনা এবং বীমা খাতের সার্বিক বিষয় বিবেচনায় নিয়ে বর্তমান ব্যয় সীমা নির্ধারণ করা হয়েছিল। এখন সেই সীমা যদি হঠাৎ করে কমিয়ে আনা হয় তাহলে কোম্পানিগুলোর জন্য সেটা কঠিন হবে।

তিনি বলেন, প্রায় ৬০ শতাংশের মতো কোম্পানি এখনো নিয়মের মধ্যে নেই। এই অবস্থায় যদি ব্যয় সীমা আরো কমিয়ে আনা হয় তাহলে কোম্পানিগুলোর টিকে থাকা কঠিন হয়ে পড়বে। এক্ষেত্রে বর্তমান ব্যয়সীমা আরো ২/৩ বছর বহাল রেখে ধাপে ধাপে কোম্পানিগুলোকে নিয়মের মধ্যে আনার চেষ্টা করতে পারে আইডিআরএ।

বেঙ্গল ইসলামি লাইফ ইন্স্যুরেন্সের মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা এমএম মনিরুল আলম বলেন, ব্যবস্থাপনা ব্যয় বলতে আসলে শুধু কমিশনকে বুঝায় না। কমিশন ও অপারেশনাল এক্সপেন্স তথা বীমা দাবি বাদে সবই ব্যবস্থাপনা ব্যয়। এক্ষেত্রে প্রচলিত কমিশন সিডিউলে পরিবর্তন না এনে ব্যয় সীমা কমানো হলে বীমা আইনের সাথে কমিশন সিডিউল কনফ্লিক্ট করবে।

তিনি আরো বলেন, লাইফ বীমা খাতের অনেক কোম্পানি বর্তমানের প্রশ্নবিদ্ধ ব্যয় সীমার বাইরে অতিরিক্ত খরচ করছে। এসব কোম্পানিকে আগে ব্যয় সীমার মধ্যে আনা প্রয়োজন। এক্ষেত্রে তাদেরকে সময় দিয়ে বর্তমানে প্রচলিত নির্ধারিত ব্যয় সীমার মধ্যে খরচ করতে বাধ্য করতে হবে। এ জন্য প্রয়োজনে আইডিআরএ’কে আরো কঠোর হতে হবে।

বিশিষ্ট বীমা ব্যক্তিত্ব চার্টার্ড লাইফ ইন্স্যুরেন্সের সাবেক মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা এস এম জিয়াউল হক বলেন, লাইফ বীমা খাতের ব্যবস্থাপনা ব্যয় অবশ্যই কমানো প্রয়োজন; তবে হঠাৎ করেই নয়। এক্ষেত্রে বহুবছরের পুরনো লাইফ বীমা পরিকল্পগুলো আগে রিভিউ করা প্রয়োজন এবং কমিশন সিডিউল পুনর্নির্ধারণ করতে হবে। একইসঙ্গে যাচাই-পর্যালোচনা করতে হবে এ খাতের ব্যবস্থাপনা ব্যয়ের হার কতটুকু কমানো যেতে পারে।

এক্ষেত্রে অবশ্যই একচ্যুয়ারিয়াল রিকমেন্ডেশন জরুরি বলে মনে করেন চার্টার্ড লাইফ ইন্স্যুরেন্সের সাবেক মুখ্য নির্বাহী এস এম জিয়াউল হক।