মটর লায়াবিলিটি বীমা চালু হল ঠিকই কিন্তু নাই কোন বাধ্যবাধকতা
মো. মানসুর আলম সিকদার, এমবিএ, এলএলবি: বহু কাঙ্খিত মটর লায়াবিলিটি ইন্স্যুরেন্স নামক পরিকল্পটি চালু করেছে কর্তৃপক্ষ এই জন্য বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষকে অভিনন্দন জানাচ্ছি। পূর্বে মটরের তৃতীয় পক্ষের বীমাটি বাধ্যতামূলক ছিল কিন্তু ২০১৮ সালের সড়ক পরিবহন আইনের ধারা ৬০ এর ১, ২ ও ৩ উপধারা অনুযায়ী মোটরযানের জন্য বীমা বাধ্যতামূলক নয় অথবা বীমা না করলে শাস্তির বিধানটি উঠিয়ে দেয়া হয়েছে বিধায় পলিসিটি সেচ্ছায় মালিকগণ কতটুকু গ্রহন করবে সেটাই এখন দেখার বিষয়। যদিও ১ (এক) বছরের জন্য পাইলট প্রকল্প হিসেবে মটর লায়াবিলিটি ইন্স্যুরেন্স প্রকল্পটি চালু করা হয়েছে। আশা করছি এটাই চূড়ান্তভাবে পরিপূর্নতা লাভ করবে। কেননা সার্কুলারকৃত সার্কুলার নং:- নন-লাইফ ১০৫/২০২৫ যে ধারনা দেয়া হয়েছে এবং যে উদ্দেশ্য এখানে নিহিত আছে সেটা অত্যন্ত চমৎকার কিন্তু সার্কুলারের পূর্ণাঙ্গ বিষয়াদি পরিষ্কারভাবে প্রদান করা হয় নাই। তবে আশা করছি সেটার পরিষ্কার ধারনা বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ অবশ্যই আমাদেরকে প্রদান করবে।
দৃশ্যত মনে হচ্ছে সার্কুলার নং:- নন-লাইফ ১০৫/২০২৫ অনুযায়ী পূর্বের ট্যরিফে প্রতি অনুশরন করে মটর লায়াবিলিটি ইন্স্যুরেন্স এর ক্ষেত্রে অ্যাক্ট বেসিক প্রিমিয়াম, প্যাসেন্জার, ড্রাইভার, হেল্পার এবং কন্ডাক্টরদের পূর্বের ট্যরিফের উল্লেখিত প্রিমিয়াম হারের ৫ গুন করা হয়েছে। অর্থাৎ সার্কুলার পর্যালচনা করলে মনে হচ্ছে ট্যরিফের সমস্ত কিছুই ঠিক থাকবে, শুধুমাত্র অ্যাক্ট বেসিক প্রিমিয়াম, প্যাসেন্জার, ড্রাইভার, হেল্পার এবং কন্ডাক্টরদের পূর্বের ট্যরিফের উল্লেখিত প্রিমিয়ামের ৫ গুনহারে বর্ধিত করে প্রিমিয়াম ধার্য্য করতে হবে। যখন আমরা কম্প্রিহেন্সিভ ইন্স্যুরেন্স করব তখন আমাদেরকে অবশ্যই নতুন সার্কুলাকৃত নন-লাইফ:-১০৫/২০২৫ অনুযায়ী অনুসরন করে কম্প্রিহেন্সিভ ইন্স্যুরেন্স করতে হবে, নতুবা সেটাকে আমরা কম্প্রিহেন্সিভ ইন্স্যুরেন্স বলতে পারব না, এটাই হচ্ছে মোদ্দা কথা। কর্তৃপক্ষের প্রতি যথাযথ সম্মান রেখে বলা হচ্ছে এই লেখনির মাধ্যে মটর লায়াবিলিটি বীমার সার্কুলাকৃত নন-লাইফ:-১০৫/২০২৫ যদি আমরা বুজতে ভুল করি তবে আশা করছি বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ আমাদেরকে আরও পরিষ্কার ধারনা প্রদান করবেন।
নিম্নে নতুন পরিকল্পটির প্রিমিয়ামের হার দেয়া হল:
১) মটর সাইকেলের ক্ষেত্রে: উদাহরণ সরূপ-মটর সাইকেল (ক) সিসি: ১৫০ সীট ১+১। আপটু সিসি: ১৫০= বেসিক ১০০ (১০০ x ৫)= অ্যাক্ট বেসিস ৫০০ হবে। (খ) পূর্বের ট্যরিফে প্যাসেন্জার ছিল ৪৫ টাকা, কর্তমানে হবে (৪৫x৫)= প্রতি প্যাসেন্জার ২২৫ টাকা। (গ) ড্রাইভারের প্রিমিয়ামে হার প্রতি প্যাসেন্জার ছিল ৩০ টাকা, বর্তমানে হবে (৩০x৫)= ড্রাইভার ১৫০ টাকা। এখানে নীটি প্রিমিয়াম দাড়ায় (৫০০+২২৫+১৫০)= ৮৭৫ ভ্যট:১৩১= মোট ১,০০৬ টাকা।
উপরোক্ত ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে হলে পূর্বের ট্যরিফে আছে যেমন: (i) আপটু সিসি: ১৫০ = বেসিক ১০০, ii) আপটু সিসি: ২৫০= বেসিক ১৩০, iii) আপটু সিসি: ৩৫০= বেসিক ১৬০ অর্থাৎ বর্তমান বেসিক হবে উক্ত বেসিক অ্যামাউন্ট এর ৫ (পাঁচ) গুণ।
২) ত্রিচক্রযান: (সিসি: ৩৫০, সীট: ৩+১) এর ক্ষেত্রে: (৬৫০+৬৭৫+১৫০)=১,৪৭৫ ভ্যাট: ২২১ মোট প্রিমিয়াম: ১,৬৯৬ টাকা।
৩) প্রাইভেট কার (সিসি: ১৩০০. সীট: ৪+১) এর ক্ষেত্রে: (৭৫০+৯০০+১৫০)=১,৮০০ ভ্যাট: ২৭০ মোট প্রিমিয়াম ২,০৭০ টাকা।
৪) ট্রাক (টন: ৩, সীট: ১+১) এর ক্ষেত্রে: (২,৮০০+২২৫+১৫০) নেট প্রিমিয়াম ৩,১৭৫, ভ্যাট: ৪৭৬ মোট প্রিমিয়াম ৩,৬৫১ টাকা।
প্রাথমিকভাবে নন-লাইফ বীমা কোম্পানিগুলো পাইলট ভিত্তিতে ১ বছরের জন্য এই বীমা পলিসির বিক্রি করতে পারবে। এক্ষেত্রে এক বছর শেষে বীমা পলিসিটির পরিসংখ্যান কর্তৃপক্ষের নিকট পাঠাতে হবে। তবে এই মোটর বীমা গ্রহণের ক্ষেত্রে কোন বাধ্যবাধকতা নেই বলে জানিয়েছেন বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ (আইডিআরএ)’র মিডিয়া এন্ড কমিউনিকেশন পরামর্শক ও মুখপাত্র।
বি.দ্র: প্রদত্ত সিডিউলটি নিয়ে মন্তব্য: সার্কুলাকৃত নন-লাইল:- ১০৫/২০২৫ (নমুনা সরূপ) সিডিউলে কেন যেন শুধু মাত্র অ্যাক্ট বেসিক ৭৫০ টাকা এবং ভ্যাট ১১৩ টাকা (৭৫০+১১৩)= ৮৬৩ দেখানো হয়েছে কিন্তু প্যাসেন্জার, ড্রাইভার, হেল্পার এবং কন্ডাক্টরদের প্রিমিয়াম উল্লেখ করা হয় নাই। প্রশ্ন হচ্ছে তবে কি মোটর লায়াবিলিটি ইন্স্যুরেন্সের ক্ষেত্রে কি প্যাসেন্জার, ড্রাইভার, হেল্পার এবং কন্ডাক্টরদের প্রিমিয়াম নেয়া বাধ্যতা মূলক না? ব্যপারটি পরিষ্কার হওয়া প্রয়োজন।
২০১৮ সালের সড়ক পরিবহন আইনে বলা হয়েছে কেউ ইচ্ছা করলে তার যানবাহনের বীমা করতে পারেন, আবার না করলেও কোন সমস্যা নেই, অর্থাৎ মটর বীমা না করলে কোন ধরনের জড়িমানার সম্মুখীন হতে হবে না। এটি অন্য অনেক বীমা পরিকল্পের মতো অপশনাল করে দেয়া হয়েছে। উর্ধ্বতনদের নির্দেশনায় ২০২০ সালের ২০ ডিসেম্বর সার্কুলার নং- নন-লাইফ ৮২/২০২০ জারি করে যানবাহনের ক্ষেত্রে থার্ড পার্টি বীমা পরিকল্প বাতিল করে বীমা খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থা আইডিআরএ।
ঐ বছরের অক্টোবরে মটরযান অধ্যাদেশ, ১৯৮৩ রহিত করে সড়ক পরিবহন আইন, ২০১৮ জারির মাধ্যমে সরকার যানবাহনের থার্ড পার্টি বীমা তুলে দিলে এই সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হয় আইডিআরএ। তা ছাড়া রাজনৈতিক কিছু কারণও এখানে বিদ্যমান ছিল। খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, নতুন এই মোটর বীমা ব্যাপকভাবে চালু হলে দেশের নন-লাইফ বীমা খাতে যে নেতিবাচক অবস্থা তৈরি হয়েছিল সেটি দূর হবে এবং ব্যবসার ভলিউম বাড়বে। একইসঙ্গে বীমা পেনিট্রেশন বৃদ্ধিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখবে নতুন এই পলিসি।
দুর্ঘটনায় ক্ষতিপূরণ নির্ধারণ হবে যেভাবে সেটি (তফসিল থেকে) সংক্ষিপ্তভাবে নিম্নে দেয়া হল:
ক) আইডিআরএ’র সার্কুলার অনুসারে এই পলিসির আওতায় বীমাকৃত যানবাহন দুর্ঘটনায় পড়লে এবং এ কারণে কোন যাত্রীর মৃত্যু হলে এককালীন সর্বোচ্চ ২ লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ দেয়া হবে।
খ) আর দুর্ঘটনায় আঘাতপ্রাপ্ত হলে স্থায়ী সম্পূর্ণ অক্ষম হলে জনপ্রতি এককালীন সর্বোচ্চ ২ লাখ টাকা বীমা কাভারেজ দেয়া হবে। আর আংশীক স্থায়ী অক্ষমতা তৈরি হলে তফসিলে নির্ধারিত হারে ক্ষতিপূরণ দেয়া হবে।
গ) এ ছাড়াও গুরুতর আহত কিন্তু চিকিৎসার মাধ্যমে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসার সম্ভাবনা থাকলে জনপ্রতি এককালীন সর্বোচ্চ ২০ হাজার টাকা ক্ষতিপূরণ প্রদান করা হবে।
ঘ) অপরদিকে দুর্ঘটনায় তৃতীয় পক্ষের সম্পত্তির ক্ষতি হলে সর্বোচ্চ ৬০ হাজার টাকা ক্ষতিপূরণ দেয়া হবে।
ঙ) এ ছাড়াও আদালতের ফি, সালিশ ফি, আইনী প্রতিনিধিত্ব এবং সংশ্লিষ্ট অন্যান্য ফি বাবদ সর্বোচ্চ ১০ হাজার টাকা প্রদান করা হবে।
কিছু পর্যালচনা:
১) উক্ত সার্কুলারে যে ভাবে বর্ণিত আছে সেগুলো মূল্যায়ন করলে ধরা যেতে পারে যেমন: i) Three Wheeler (ত্রিচক্রযান): সিএজি, রিক্সা, টেম্পু, ii) প্রাইভেট ভেহিকেল iii) কমার্শিয়াল ভেহিকেল, iv) ক্লাস-ডি যেমন: ক্রেন, রোড রোলার, বুলডোজার, ট্রাক্টর, অ্যাম্বুলেন্স ইত্যাদির ক্ষেত্রে অ্যাক্ট বেসিক রেট যা আছে তার ৫ গুন প্রিমিয়াম নিতে হবে। ঠিক একই ভাবে প্যাসেন্জার ছিল ৪৫ টাকা, বর্তমানে হবে (৪৫x৫)= প্রতি প্যাসেন্জার ২২৫ টাকা। ড্রাইভার, হেলপার, কন্ডাক্টর, প্রিমিয়ামে হার ছিল ৩০ টাকা করে, বর্তমানে হবে (৩০x৫) প্রতিজনে ১৫০ টাকা। যদিও কথাগুলো সার্কুলারের পরিষ্কারভাবে বলা হয় নাই।
২) মটর কম্প্রিহেন্সিভ বীমা করার ক্ষেত্রে নন-লাইফ ১০৫/২০২৫ অনুযায়ী প্রিমিয়াম ধার্য করতে হবে কিনা সেটা পরিষ্কার ভাবে বলা হয় নাই। কিন্তু উক্ত সার্কুলারে যে ভাবে বর্ণিত আছে সেগুলো মূল্যায়ন করলে ধরা যেতে পারে যে, উক্ত সার্কুলারের বর্ণিত প্রিমিয়াম সংযুক্ত করতে হবে।
৩) মটর লায়াবিলিটি ইন্স্যুরেন্স এর ক্ষেত্রে ৫ টণ= ৭০০ but when each additional ton/less ton (+ / -) 10% for Act basic premium নিয়মটি ঠিক থাকবে। কিন্তু এ ব্যপারে নতুন নন-লাইফ:- ১০৫ সার্কুলারে কিছুই উল্লেখ করা হয় নাই।
৪) মটর লায়াবিলিটি ইন্স্যুরেন্স এর ক্ষেত্রে বীমা ষ্ট্যাম্প কত টাকা ব্যবহার করতে হবে তা নন-লাইফ-১০৫ সার্কুলারে কিছুই উল্লেখ নাই। তাই আমরা ধরে নিতে পারি যে, মটর লায়াবিলিটি ইন্স্যুরেন্স এর ক্ষেত্রে ষ্ট্যাম্প পূর্বের ন্যায় ৫ টাকার বীমা ষ্ট্যাম্প ব্যবহার করতে হবে।
তদুপরিও পরিশেষে আমরা বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষকে অভিনন্দন জানাচ্ছি এই জন্য যে, অনেক সাহস নিয়ে মটর লায়াবিলিটি ইন্স্যুরেন্স নামক পরিকল্পটি চালু করেছে। মটর থার্ড পার্টি বন্ধ করা হয়েছিল রাজনৈতিকভাবে এবং সাবেক প্রধান মন্ত্রী শেখ-হাসিনার এক তরফা গোয়ারতুমির কারণে যা কোন ক্রমেই কাম্য ছিল না। পরিশেষে অনুরোধ করব সাবেক প্রধান মন্ত্রী শেখ হাসিনাকে খুশী করার জন্য মটর অ্যাক্ট লায়াবিলিটি পরিকল্পটি বাতিল করা হয়েছিল, তার ইচ্ছা, ধ্যন ধারনা বাদ দিতে হবে। তাই নন-লাইফ-১০৫ সার্কুলারের নিয়মটি ঠিক রেখে মটর লায়াবিলিটি ইন্স্যুরেন্স পলিসিটির নাম সংশোধন করে সেটাকে পুনরায় মটর অ্যাক্ট লায়াবিলিটি পরিকল্পটি বহাল রেখে কর্তৃপক্ষ পূনরায় আরএকটি নতুন সার্কুলার প্রদান করলে জাতী খুশী হবে।