সানলাইফের কাছে গ্রাহকরা আসলে কত টাকা পায়!
নিজস্ব প্রতিবেদক: বেসরকারি লাইফ বীমা কোম্পানি সানলাইফ ইন্স্যুরেন্সের কাছে গ্রাহকরা আসলে কত টাকা পায়! আর কত টাকা পরিশোধ করেছে কোম্পানিটি! দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের সানলাইফের বীমাকর্মী ও কর্মকর্তাদের অভিযোগ শত কোটি টাকা বকেয়া। কোনো কোনো অঞ্চলে একটি ব্রাঞ্চ বা সার্ভিসিং সেলের ১০ কোটি টাকা পর্যন্ত গ্রাহকদের পাওনা রয়েছে কোম্পানির কাছে। মাসের পর মাস ধর্ণা দিয়েও গ্রাহরা এ টাকা আদায় করতে পারছে না। এমনটাই দাবি দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের ব্রাঞ্চ ও সার্ভিস সেল ইনচার্জ সংগঠন প্রধান ও এজেন্টদের।
অন্যদিকে সানলাইফ ইন্সুরেন্স কোম্পানি কর্তৃপক্ষ বলছে, ৮২ শতাংশেরও বেশি বীমা দাবি পরিশোধ করা হয়েছে। তাদের দাবি মাঠপর্যায়ের কর্মীরা সঠিক তথ্য দিচ্ছে না। ব্রাঞ্চ বা সার্ভিস সেলের ইনচার্জরা যা বলছে তা সঠিক নয়।
পরস্পর বিরোধী দাবির প্রেক্ষিতে, আসলে সানলাইফ ইন্স্যুরেন্সের কাছে গ্রাহকদের পাওনা কত। এই পাওনা নিয়ে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে কেমন অবস্থা তা অনুসন্ধানে নামে ইন্স্যুরেন্স নিউজ বিডি। গত দুই সপ্তাহ আগে সরেজমিনে খোঁজ-খবর নিতে যাওয়া হয় দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমা অঞ্চলে।
মোকসেদপুর, ফরিদপুর, চুয়াডাঙ্গা, রাজবাড়ি ও মেহেরপুর এলাকার ব্রাঞ্চ ইনচার্জ ও সার্ভিস সেল ইনচার্জদের সাথে আলাপকালে তারা অভিযোগ করেন, এ এলাকায় হাজার হাজার গ্রাহক মাসের পর মাস টাকা পাচ্ছে না। গ্রাহকরা দল বেধে কখনো অফিস ঘেরাও করছে, কখনো আইনের আশ্রয় নিচ্ছে। কখনো বা টাকা আদায়ে স্থানীয় রাজনৈতিক কর্মী বা প্রভাবশালীদের কাছে ধর্ণা দিচ্ছে।
অবস্থা এমন, পাওনাদার গ্রাহকদের সামলাতেই হিমসীম খাচ্ছে ব্রাঞ্চ ইনচার্জ ও সার্ভিস সেল ইনচার্জরা। প্রতিদিনই অফিসে ভীড় করছে শত শত গ্রাহক। তবে এরমধ্যে চরম বিপাকে পড়েছে নারী বীমা কর্মীরা। যাদের বেশিরভাগই অল্প শিক্ষিত। গ্রাহকরা পাওনা টাকার জন্য তাদের বাড়িতে যাচ্ছে। যার প্রভাব পড়ছে পুরো পরিবারের উপর। অনেকে পড়েছে স্বামী শশুর-শাশুরীর চাপের মুখে। তারা চাপ দিচ্ছে এসব নারীদের।
তবে এমন অবস্থার কেনো তথ্যই পাচ্ছে না বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ (আইডিআরএ) । কোম্পানিটি গ্রাহকদের দাবি না মিটিয়ে তা বিভিন্নভাবে আড়াল করছে নিয়ন্ত্রক সংস্থার কাছে।
অভিযোগ উঠছে কোম্পানির কাছে গ্রাহকদের পাওনা কোম্পানির আর্থিক অবস্থা এসব তথ্য আড়াল করে ফায়দা লুটছে কোম্পানির উর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের একটি শ্রেণী। অন্যদিকে নিজেদের আর্থিক খারাপ অবস্থা ও অব্যবস্থাপনার চিত্র আড়াল করে উর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের দেয়া তথ্যই সন্তুষ্ট পরিচালনা পর্ষদ।
চলতি মাসে লাইফ ও নন-লাইফ বীমা কোম্পানির একটি ত্রৈমাসিক মূল্যায়ন প্রতিবেদন তৈরি করে আইডিআরএ। এ মূল্যায়ন প্রতিবেদন পাঠানো হয় সরকারি বেসরকারি সকল বীমা কোম্পানির কাছে।
এ প্রতিবেদেন অনুসারে চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে মার্চ পর্যন্ত কোম্পানিটি মেয়াদোত্তীর্ণ দাবি পরিশোধ করেছে ৯ কোটি ২৫ লাখ ৮১ হাজার টাকা। যা মোট দাবির ৮২.৪৪ শতাংশ। আর বকেয়া রয়েছে ১ কোটি ৯৭ লাখ ১৯ হাজার ৮৮০ টাকা।
অথচ আলোচ্য সময়ে কুষ্টিয়ার একটি সার্ভিসিং সেলেই গ্রাহকদের টাকা বকেয়া রয়েছে ৭ কোটি ২৩ লাখ ৩৫ হাজার ৩৪৫ টাকা। এমন অবস্থায় প্রশ্ন উঠেছে, কোম্পানিটি ৮২.২৩ শতাংশ দাবি পরিশোধ করলে এত টাকা দাবি বকেয়া থাকে কিভাবে।
চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে মার্চের ৭ তারিখ পর্যন্ত কুষ্টিয়া সার্ভিসিং সেলে ৪৩২১ জনের মেয়াদোত্তীর্ণ দাবির পরিমাণ ৬ কোটি ৮৩ লাখ ৬১ হাজার ২৯ টাকা। এর মধ্যে ওই তিন মাসে ৩৪১ জন গ্রাহককে ৫৪ লাখ ৭৮ হাজার ১৪৯ টাকা পরিশোধ করা হয়। বাকি ৩৯৮০ জন গ্রাহকের ৬ কোটি ৮২ লাখ ৮৮০ টাকা পরিশোধ করেনি সানলাইফ ইন্স্যুরেন্স।
আবার পরের এক মাসে অর্থাৎ মার্চের ৮ তারিখে থেকে এপ্রিল মাসের ১৮ তারিখ পর্যন্ত নতুন করে মেয়াদোত্তীর্ণ দাবির জন্য ৬৯২ জন গ্রাহক আবেদন করে। যাদের দাবিকৃত টাকার পরিমাণ ১ কোটি ১০ লাখ ২ হাজার ৬৬৪ টাকা। ফলে ওই সার্ভিসিং সেলে নতুন পুরনো মিলে ৪৬৭২ জন গ্রাহকের বকেয়া দাবির পরিমাণ দাড়ায় ৭ কোটি ৩৮ লাখ ৮৫ হাজার ৭৪৪ টাকা। তবে এর মধ্যে ৫৬৯ জন গ্রাহককে ৯৪ লাখ ৫২ হাজার ৪৬৫ টাকা পরিশোধ করে। ফলে এপ্রিল শেষে ৪৫৪৯ জন গ্রাহকের বকেয়া দাবির পরিমাণ দাঁড়ায় ৭ কোটি ২৩ লাখ ৩৫ হাজার ৩৪৫ টাকা।
অপর দিকে আইডিআরএ’র কাছে দাখিল করা তথ্য ও ব্রাঞ্চ অফিস থেকে সানলাইফের প্রধান কার্যালয়ের তথ্যের মধ্যেও রয়েছে ব্যবধান ওঠে এসেছে ইন্স্যুরেন্স নিউজ বিডির অনুসন্ধানে।
চলিত বছরের ৮ জানুয়ারি আইডিআরএ’র কাছে দাখিল করা তথ্যে দেখা যায, গত বছরের নভেম্বর মাসে পলিসির মেয়াদ পূর্ণ হয়েছে এমন ৫৩০জন গ্রাহক ৭৯ লাখ ৫০ হাজার টাকা দাবির জন্য আবেদন করেছে। অথচ কোম্পানির কুষ্টিয়ার গণমুখী সার্ভিসিং সেল থেকে প্রধান কার্যালয়ে পাঠানো তথ্য অনুসারে গত বছরের অক্টোবর ১২ তারিখ থেকে নভেম্বরের ১৪ তারিখ পর্যন্ত মেয়াদ পূর্ণ হয়েছে এমন ১৪৭৪ জন গ্রাহক আবেদন করেছে। যাদের দাবির পরিমাণ ২ কোটি ৩৫ লাখ ৮৪ হাজার।
এমন তথ্যে প্রশ্ন দাঁড়িয়েছে আসলে কোম্পানিটির পরিশোধযোগ্য দাবির পরিমাণ কত।
সানলাইফের গ্রাহকদের পাওনা নিয়ে কথা বলা হয় দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের একাধিক মাঠ কর্মীর সাথে। এর মধ্যে যেসব কর্মকর্তা ব্রাঞ্চ বা সার্ভিসিং সেলের দায়িত্বে আছেন তারা চাঞ্চল্যকর তথ্য দেন। তবে এদের কেউই নাম প্রকাশে রাজি হননি।
তাদের দেয়া তথ্য মতে, গত দু’এক মাসে সানলাইফের বকেয়ার পরিমাণ দাঁড়িয়েছে শত কোটি টাকার উপরে। কিন্তু এর কোনো তথ্য মালিকপক্ষ বা পরিচালনা পর্ষদের কাছে উপস্থাপন করা হয় না। অধিকাংশই গোপন রাখা হয়। এ কাজটি করেন কোম্পানির শীর্ষ পর্যায়ের কর্মকর্তারা।
তাদের মতে, কোম্পানির উর্ধ্বতন কর্মকর্তারা নিজেদের বেতন ভাতা সঠিকভাবে পাওয়ার জন্য পরিচালনা পর্ষদের কাছে সঠিক তথ্য দেন না। তারা বরাবরই পর্ষদকে জানান, মাঠে কিছু সমস্যা রয়েছে। যতটা শোনেন ততটা না। কিছু কর্মী ছাঁটাই করা হয়েছে। তারাই বিদ্রোহী হয়ে গ্রাহকের পাওনা বেশি বেশি দেখিয়ে প্রচার করছে।
শত শত গ্রাহকের দাবি পরিশোধ না করায় চরম অস্থিরতা রয়েছে মাঠকর্মীদের মধ্যে। দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে দাবি পরিশোধ না করতে পারায় কোম্পানির স্থানীয় ব্রাঞ্চ ও সার্ভিসিং সেলগুলোর মাঠ কর্মী ও কর্মকর্তারা পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। এর মধ্যে কুষ্টিয়া, রাজশাহী, চাপাইনবাগঞ্জের বিভিন্ন এলাকায় কোটি কোটি টাকা দাবি বকেয়া।
এমন পরিস্থিতি সামলাতে মাঠকর্মীরা অফিস করতে পারছে না। কুষ্টিয়ার সার্ভিসিং সেলের একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ভাই কিছু করার নেই, প্রতিদিন শত শত গ্রাহককে সামলাতে হয়। অফিসে আসি লুকিয়ে। অফিসের সামনে গ্রাহকরা বসে পরে। টাকা না দিলে যাবে না। তখন পালানো ছাড়া উপায় থাকে না। উর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের বললে তারা বলেন, সামলান। নতুন প্রিমিয়াম নেন, গ্রাহকদের টাকা দেন। প্রধান কার্যালয়ে গ্রাহকদের তালিকা নিয়ে দিনের পর দিন ধর্ণা দিয়েও কাজ হয় না। আমরা তো মালিকদের কাছে যেতে পারি না। কি করব কুল কিনারা পাচ্ছি না।