মূখ্য নির্বাহী ছাড়াই চলছে বীমা ব্যবসা

আবদুর রহমান আবির: মূখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা ছাড়াই ব্যবসা পরিচালনা করে আসছে দেশের বেশ কয়েকটি লাইফ ও নন-লাইফ বীমা কোম্পানি। এ অবস্থা চলছে বছরের পর বছর ধরে। কোন কোম্পানির নিবন্ধন প্রাপ্তির পর থেকেই মূখ্য নির্বাহী নিয়োগ দেয়া হয়নি। আইনে মূখ্য নির্বাহী কর্মকর্তার পদ সর্বোচ্চ ৬ মাস শূন্য থাকলে প্রশাসক নিয়োগের বিধান রয়েছে। অথচ কোন কোন কোম্পানির মূখ্য নির্বাহীর পদ ৫ বছর ধরে শূন্য থাকলেও প্রশাসক নিয়োগের কোন উদ্যোগ নেয়নি বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ।

মূখ্য নির্বাহীর পদ শূন্য রাখা নিয়ে বীমা সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলেছে ইন্স্যুরেন্স নিউজ বিডি। এতে বীমাখাত সংশ্লিষ্টরা ভিন্ন ভিন্ন মতামত ব্যক্ত করেছেন। কারো কারো মতে, বীমাখাতে যোগ্যতা সম্পন্ন লোকের অভাব রয়েছে। এ কারণেই যোগ্যতা সম্পন্ন লোক না পাওয়ায় অনেক কোম্পানি নির্ধারিত সময়ের মধ্যে মূখ্য নির্বাহী নিয়োগ দিতে পারছে না।

তবে বেশিরভাগের মতে, বীমা কোম্পানির পরিচালনা পর্ষদ কোম্পানির কার্যক্রম নিজেদের নিয়ন্ত্রণে রাখতে ও অনৈতিক সুবিধা হাতিয়ে নিতে নিজেদের পছন্দের লোককেই মূখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা নিয়োগ দিতে চায়। তাই তারা নিজেদের পছন্দের লোকদের মধ্য থেকে মূখ্য নির্বাহী পদের যোগ্যতা সম্পন্ন লোক না পাওয়ায় অযোগ্য লোকদেরকে নানা কৌশলে চলতি দায়িত্ব দিয়ে কোম্পানি পরিচালনা করে।

অন্যদিকে বীমা বিশ্লেষকরা মনে করেন, মূখ্য নির্বাহী কোম্পানির মূল চালিকাশক্তি। সর্বোচ্চ এ পদ শূন্য রাখা আইনের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। এক্ষেত্রে আইনের যে বিধান রয়েছে তা পরিপালন না করাও আইনের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। বীমাখাতে শৃঙ্খরা ও উন্নয়নের স্বার্থে কোন কোম্পানি ৬ মাসের মধ্যে মূখ্য নির্বাহী নিয়োগ দিতে না পারলে বীমা আইন অনুসারে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া উচিত।

ইন্স্যুরেন্স নিউজ বিডি’র অনুসন্ধানে জানা গেছে, প্রায় দু’বছর ধরে ভারপ্রাপ্ত মূখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা দিয়ে ব্যবসা পরিচালনা করে আসছে সাউথ এশিয়া ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি লিমিটেড। সামসের হাসান বর্তমানে কোম্পানিটির মূখ্য নির্বাহী কর্মকর্তার দায়িত্ব পালন করছেন। ২০১৭ সালের ২ মে তিনি কোম্পানিটিতে যোগদান করেন এবং একই বছরের ১ জুন থেকে মূখ্য নির্বাহীর চলতি দায়িত্বে রয়েছেন।

এর আগে ২০১৬ সালের ২৬ জানুয়ারি ৩ বছরের জন্য কোম্পানিটির সিইও হিসেবে আইডিআরএ’র অনুমোদন পান বায়েজীদ মুজতবা সিদ্দিকী।  তবে ২০১৭ সালের ৩১ মে চাকরি থেকে ইস্তফা দেন বায়েজীদ মুজতবা সিদ্দিকী। এরপর থেকেই কোম্পানিটির সিইও পদ শূন্য হয়ে পড়ে। ১৯৯৯ সালের ২৯ ডিসেম্বর বীমা ব্যবসার নিবন্ধন পায় সাউথ এশিয়া ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি।

অন্যদিকে প্রায় এক বছর ধরে মূখ্য নির্বাহী কর্মকর্তার পদ শূন্য রয়েছে সিকদার ইন্স্যুরেন্সের।কোম্পানিটি ভারপ্রাপ্ত মূখ্য নির্বাহী দিয়ে ব্যবসা করে আসছে। বর্তমানে কোম্পানিটির ডিএমডি বদিউল আলম ভারপ্রাপ্ত মূখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। এর আগে তিনি ন্যাশনাল ব্যাংকের এএমডি ছিলেন।

২০১৮ সালের ২ এপ্রিল মো. আমিনুর রহমান’র পদত্যাগের মধ্য দিয়ে মূখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা শূন্য হয়ে পড়ে সিকদার ইন্স্যুরেন্স। ২০১৭ সালের জুন মাসে কোম্পানিটিতে মূখ্য নির্বাহী হিসেবে যোগদান করেন আমিনুর রহমান। এর আগে তিনি মার্কেন্টাইল ইন্স্যুরেন্সের মূখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা ছিলেন।  

২০১৩ সালের জুলাইয়ে বীমা ব্যবসার অনুমোদন লাভের পর থেকে সিকদার ইন্স্যুরেন্সের মূখ্য নির্বাহী কর্মকর্তার দায়িত্বে ছিলেন তৌফিক। ২০১৭ সালের জুনে কোম্পানিটির মূখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা হিসেবেই তিনি পদত্যাগ করেন।  চাকরির শেষ বয়স ৬৭ বছর পূর্ণ হওয়ার মাস তিনেক আগেই পদত্যাগ করেন তৌফিক।

এনআরবি গ্লোবাল লাইফ দু’বছরের বেশি সময় ধরে মূখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা ছাড়াই ব্যবসা পরিচালনা করে আসছে। কোম্পানিটির অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ আবু মুসা সিদ্দিকী বর্তমানে ভারপ্রাপ্ত মূখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা হিসেবে চলতি দায়িত্ব পালন করছেন।

জানা গেছে, ২০১৭ সালের ১১ মার্চ এনআরবি গ্লোবাল লাইফের মূখ্য নির্বাহী কর্মকর্তার পদ থেকে অব্যহতি নেন অমল কান্তি দাস। এরপর থেকেই মূখ্য নির্বাহী পদ শূন্য হয়ে পড়ে চতুর্থ প্রজন্মের বেসরকারি এই লাইফ বীমা কোম্পানি।

পরবর্তীতে কামরুল হাসানকে মূখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা হিসেবে নিয়োগের সিদ্ধান্ত নেয় এনআরবি গ্লোবাল লাইফ। সিদ্ধান্ত অনুসারে প্রয়োজনীয় কাগজপত্রসহ আইডিআরএ’র অনুমোদন চেয়ে আবেদনও করা হয়। তবে ২০১৭ সালের ৩ অক্টোবর কাজে অনাগ্রহ প্রকাশ করেন কামরুল হাসান।

এ অবস্থায় এনআরবি গ্লোবাল লাইফের অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ আবু মুসা সিদ্দিকীকে সিইও’র দায়িত্বভার দেয়া হয়। এরপর ২০১৮ সালের ১৯ মে তাকে ৩ বছরের জন্য সিইও নিয়োগে আইডিআরএ’র অনুমোদন চায় কোম্পনি কর্তৃপক্ষ। তবে অদ্যবধি তিনি অনুমোদন পাননি বলে জানা গেছে।

২০১৩ সালের ২৯ জুলাই অনুমোদন লাভের পর থেকেই মূখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা ছাড়া বীমা ব্যবসা পরিচালনা করে আসছে চার্টার্ড লাইফ ইন্স্যুরেন্স। বর্তমানে কোম্পানিটির ডিএমডি এমদাদ উল্লাহ মূখ্য নির্বাহী কর্মকর্তার কার্যক্রম চালিয়ে নিচ্ছেন। এর আগে ২০১৫ সাল থেকে মূখ্য নির্বাহীর চলতি দায়িত্বে ছিলেন শহিদুল ইসলাম। মূখ্য নির্বাহী নিয়োগের সব শর্ত পূরণ না করায় তিনি অনুমোদন পাননি।

এর আগে ১৪ এপ্রিল, ২০১৪ তারিখে কামরুল হাসানকে মূখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা পদে নিয়োগ দেয় চার্টার্ড লাইফ ইন্স্যুরেন্স। তবে নিয়োগ অনুমোদনের জন্য আইডিআরএ’র কাছে আবেদন পাঠানো হলেও সিইও পদ থেকে পদত্যাগ করেন কামরুল হাসান।

এ বিষয়ে সিকদার ইন্স্যুরেন্সের ডিএমডি ও ভারপ্রাপ্ত মূখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা বদিউল আলম ইন্স্যুরেন্স নিউজি বিডি’কে বলেন, কোম্পানির মূখ্য নির্বাহী কর্মকর্তার নিয়োগ অনুমোদনের বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন রয়েছে।

চার্টার্ড লাইফের কোম্পানি সেক্রেটারি মিজানুর রহমান জানান, এপ্রিলের প্রথম দিনেই এএমডি হিসেবে যোগদান করছেন প্রগতি লাইফের বর্তমান জিএম জিয়াউল হক। তিনি কোম্পানির মূখ্য নির্বাহী কর্মকর্তার চলতি দায়িত্ব পালন করবেন। পরে কর্তৃপক্ষের অনুমোদনের জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়া হবে।

এনআরবি গ্লোবাল লাইফের অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও ভারপ্রাপ্ত মূখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা মোহাম্মদ আবু মুসা সিদ্দিকী বলেন, কোম্পানির মূখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা নিয়োগ দেয়ার দায়িত্ব পরিচালনা পর্ষদের। তারা এ বিষয়ে কি পদক্ষেপ নিচ্ছেন তা আমার জানা নেই।

এসব বিষয়ে বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের সদস্য গকুল চাঁদ দাস ইন্স্যুরেন্স নিউজ বিডি’কে বলেন, মূখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা নিয়োগের জন্য বীমা কোম্পানিগুলোকে আমরা বারবারই অনুরোধ জানিয়ে আসছি। তবে যোগ্য লোকের অভাব দেখিয়ে তারা তা বাস্তবায়ন করতে পারছে না বা করছে না।  

তিনি বলেন, বীমা আইনে ৬ মাসের বেশি সময় মূখ্য নির্বাহীশূন্য কোম্পানিতে প্রশাসক নিয়োগের বিধান রয়েছে। কিন্তু এই মুহূর্তে আমাদের এ ধরণের কোন কার্যক্রম নেই। তাছাড়া কোন লোককে আমরা প্রশাসক নিয়োগ করব। সে বিষয়ে কোন রূপরেখা নেই। তাই কোম্পানিগুলোকে আমরা মূখ্য নির্বাহী নিয়োগের অনুরোধ জানিয়ে আসছি।