চূড়ান্ত সাফল্যের পথনির্দেশ
বীমা বিষয়ে একটি পাঠক সমাদৃত বই “যে ব্যবসা সম্মানের যে ব্যবসায় মূলধন লাগে না”। ১৯৭৫ সালে প্রকাশিত বইটি লিখেছেন বাংলাদেশ জেনারেল ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি (বিজিআইসি)’র প্রতিষ্ঠাতা ম্যানেজিং ডাইরেক্টর এম এ সামাদ। ১৯৪৫ সালে তিনি কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে সম্মানসহ বিএ ডিগ্রি লাভ করেন। অল ইন্ডিয়া রেডিও’তে কর্মজীবন শুরু হলেও ১৯৫১ সাল থেকে তিনি বীমাকে সার্বক্ষণিক পেশা হিসেবে গ্রহণ করেন।বাংলাদেশের বাইরে বীমার ওপর অনুষ্ঠিত বিভিন্ন সেমিনারে তিনি যোগদান করেন। ইউএনডিপি’র ফেলোশিপ নিয়ে যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্রে সফর করেছেন এম এ সামাদ। ইন্স্যুরেন্স নিউজ বিডি’র পাঠকদের প্রয়োজনের দিকে লক্ষ্য রেখে এম এ সামাদ’র এই বই থেকে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো ধারাবাহিকভাবে হুবহু তুলে ধরা হলো। আজ থাকছে “চূড়ান্ত সাফল্যের পথনির্দেশ”।
জীবন বীমাকে যখন জীবীকা অর্জনের বৃত্তি হিসেবে গ্রহণ করেছেন তখন তার চরম সাফল্য অর্জন হচ্ছে আপনার লক্ষ্য যশ ও খ্যাতির শীর্ষে পৌঁছানোর গৌরব অর্জন করেছেন যেসব প্রতিষ্ঠিত জীবন বীমা প্রতিনিধি, তাদের পদাঙ্ক অনুসরণ করে আপনিও একদিন সাফল্যের সর্বোচ্চ শিখরে আরোহণ করবেন- এ উচ্চাকাঙ্ক্ষা দৃঢ়ভাবে মনের মধ্যে পোষণ করুন। এ কথা সবারই জানা যে, জীবনের চরম সাফল্য লাভের পথ কুসুমাকীর্ণ নয়, সহজলভ্যও নয়। এর জন্য বৎসরের পর বৎসর অটুট মনোবল নিয়ে সব রকমের বাধা-বিপত্তিকে অতিক্রম করে যেতে হয়। জীবনের যে কোন কর্মক্ষেত্রে যারাই সুপ্রতিষ্ঠিত হয়েছেন, তারা প্রায় সবাই অতি ক্ষুদ্রভাবে তাদের কর্মজীবনের সূচনা করেছেন। আপনার কর্মজীবনের প্রথমিক পর্যায়ও অতি সাধারণভাবে আরম্ভ করতে হবে। পরলোকগত শমশের আলীর মতো এশিয়ার লব্ধ-প্রতিষ্ঠিত বীমাবিদকেও জীবনের প্রারম্ভে কঠোর কঠোর সংগ্রাম করতে হয়েছিল- এ ইতিহাস আপনার নিশ্চয়ই জানা আছে। আমেরিকার বিখ্যাত বীমাবিদ Frank Bettger সাফল্যের সর্বোচ্চ শিখরে আরোহণ করেছিলেন। তার বীমা জীবনের প্রারম্ভিক ব্যর্থতা তাকেও একদিন পথভ্রষ্ট করতে চেয়েছিল; কিন্তু তিনি পথভ্রষ্ট হননি। অটুট মনোবল নিয়ে জীবন-যুদ্ধের সম্মুখীন হয়েছেন এবং পরিণামে জয়ী হয়েছেন।
সমাজের সর্ব উচ্চ স্তরের লোকের সঙ্গে মেশার এবং এই মহলে ব্যবসা করার দৃঢ় মনোবল ও উচ্চাকাঙ্ক্ষা পোষণ করুন। একজন শিল্পপতি বা একজন ব্যবসায়ী যদি গড়পড়তায় মাসে বিশ, পঁচিশ বা পঞ্চাশ হাজার টাকা রোজগার করতে পারেন, আপনি দশ হাজার টাকা রোজগার করতে পারবেন না কেন? এর জন্য দৃঢ় মনোবল থাকা চাই। অফুরন্ত উৎসাহ-উদ্দীপনা, উচ্চাকাঙ্ক্ষা ও আত্মপ্রত্যয়ের মাধ্যমে তা অর্জন সম্ভব, আরও প্রয়োজন বৃহদাকারের কর্মসূচি প্রণয়ন, যার প্রথম পদক্ষেপ হচ্ছে আপনার মাসিক উপার্জনের টার্গেট নির্ধারণ। এ টার্গেটে পৌঁছাতে হলে প্রতি মাসে কী পরিমাণে নতুন ব্যবসা করতে হবে তার একটা আনুমানিক হিসাব গ্রহণ করুন। প্রয়োজন হলে নিয়মিত সাক্ষাৎকারের সংখ্যা আরো বাড়িয়ে দিন। বিত্তশালী ব্যক্তিদের মধ্য থেকে সম্ভাব্য ক্রেতার তালিকা তৈরি করুন। বাংলাদেশে পঞ্চাশ হাজার, এক লাখ, দু’লাখ এমনকি তারও বেশি অঙ্কের একক পলিসি অনেক বিক্রি হয়। যারা এরকম মোটা অঙ্কের পলিসি বিক্রয় করেন, আপনিও তাদেরই মতো একজন নন কি? বড় বড় ক্লাবে, হোটেলে এবং রেস্তোরায় মধ্যাহ্নভোজ কিংবা নৈশভোজে নিমন্ত্রণ করে অনেক প্রতিষ্ঠিত জীবন বীমা প্রতিনিধিরা মোটা অঙ্কের ব্যবসা করে থাকেন। বলা বাহুল্য, নিমন্ত্রণ এবং আতিথেয়তা বড় ব্যবসা পাওয়ার একটা উল্লেখযোগ্য মাধ্যম। প্রতি মাসে যদি এ রকম দশ জন বিত্তশালী সম্ভাব্য ক্রেতাকে আপ্যায়িত করে ব্যবসার পরিবেশ সৃষ্টি করতে পারেন এবং এতে যদি চার-পাঁচ শত টাকা খরচও হয়- এ রকম পুঁজি নিয়োগ অত্যন্ত লাভজনক হবে। বছরে যারা ত্রিশ-চল্লিশ লক্ষ টাকার ব্যবসা করে থাকেন, সম্ভাব্য ক্রেতাদের আদর-আপ্যায়নের জন্য তারা এরকম অর্থ বিনিয়োগ করে থাকেন।
বড় পলিসি বিক্রয় করার মোটামুটি একটা পদ্ধতি তুলে ধরার অর্থ এই নয় যে, ছোট অঙ্কের পলিসি বিক্রয় করবেন না। নিশ্চয়ই করবেন। তবে এটা ঠিক করবেন আপনি নিজে প্রয়োজন ও সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে। আপনার প্রত্যেক মাসে গড়পড়তায় কী পরিমাণ উপার্জনের প্রয়োজন, তার উপর নির্ভর করছে এই সিদ্ধান্ত। লক্ষণীয় যে, দু’হাজার আর পাঁচ হাজার টাকার পলিসির জন্য যদি সময় দিতে হয় তাহলে গড়পড়তায় মাসিক উপার্জন মোটা অঙ্কের কোটায় পৌঁছতে পারবে না।
আপনার এবং আপনার পরিবারের জন্য একটি সুষ্ঠু ও সুন্দর বাজেট করে সেই বাজেট অনুযায়ী চলতে হবে; ঠিক অনুরূপভাবে আপনার ব্যবসারও একটি সুষ্ঠু বাজেট তৈরী করতে হবে। মনে রাখবেন, আপনি একজন ব্যবসায়ী; আপনাকে শুধু খরচ করলেই হবে না। কত টাকা খরচ করলে রোজগার হবে কিংবা কত টাকা খাটালে কত টাকা রোজগারের নিশ্চয়তা আছে- এসব চিন্তা করে দূরদর্শিতার সঙ্গে টাকা বিনিয়োগ করতে হবে।
অনেক জীবন বীমার প্রতিনিধি আয়-ব্যয়ের হিসাব না করে কাজ করতে থাকেন। এরকম কাজের পরিণাম লাভজনক হয় না। আপনি ব্যবসা করতে নেমেছেন, যেভাবে ব্যবসা লাভজনক হয় সেভাবেই আপনাকে টাকা বিনিয়োগ করতে হবে।
সুন্দর ও সচ্ছল পারিবারিক জীবনজাপন করুন। অর্থনৈতিক সচ্ছলতার জন্য প্রচুর পরিমাণে ব্যবসা করার পরিকল্পনা গ্রহণ করুন। আপনি যে ব্যবসায় আত্মনিয়োগ করেছেন তার বৈশিষ্ঠ হলো- এ ব্যবসায় আপনার উপার্জনের কোন সীমারেখা নেই। আপনার ইচ্ছে ও কর্মশক্তি এর সীমারেখা নির্ধারণ করবে।
জীবন বীমার ব্যবসাই হচ্ছে একমাত্র ব্যবসা, যেখানে আয়-ব্যয়ের কোন বাধ্য-বাধ্যকতা নেই; আছে অবাধ ইপার্জনের পথ। কোনো পরাধীনতা নেই, আছে স্বাধীন কর্মপ্রেরণা।
দেশ ও সমাজের সেবা করুন। মানুষের সাথে গভীরভাবে মিশুন। মানুষের সুখ-দু:খে শামিল হয়ে ভালবাসার মাধ্যমে সবকিছুই জয় করা সম্ভব। এ কথা অনস্বীকার্য যে, নিজের জীবনকে সুখী ও সমৃদ্ধিশালী করে গড়ে তুলতে হলে চাই যথেষ্ট ত্যাগ, পরিশ্রম ও মানসিক ভারসাম্য। এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি যা প্রয়োজন তা হচ্ছে- প্রবল আত্মবিশ্বাস।
দুর্ভাগ্যবশত আমাদের দেশে এ পর্যন্ত জীবনবীমা প্রতিনিধিদের কর্মজীবনে আমরা খুব অল্পই সাফল্যের নিদর্শন দেখতে পেয়েছি। এর প্রধান কারণ, শিক্ষিত খুব কম লোকই জীবন বীমাকে সার্বক্ষণিক বৃত্তি হিসেবে গ্রহণ করে থাকেন। আমাদের জীবন বীমা প্রতিনিধিদের প্রায় অধিকাংশই বেনামী ব্যবসা করে থাকেন। কখনো বা আংশিকভাবে ব্যবসা করেন। জীবন বীমার বিক্রয়শৈলী সম্পর্কে তাদের কোন জ্ঞান নেই। জীবন বীমার পেশাগত কোন যোগ্যতা তারা অর্জন করেননি। জীবনের সত্যিকারের সাফল্য এভাবে অর্জন করা যায় না।
অত্যন্ত আশার কথা- স্বাধীন বাংলাদেশে এ অবস্থার এক বৈপ্লবিক পরিবর্তন এসেছে। দেশের শিক্ষিত যুবসমাজ ইদানিং জীবন বীমাকে বৃত্তি হিসেবে গ্রহণ করে দু’চোখের সম্ভাবনার অনন্ত জ্যোতি নিয়ে সাফল্য অর্জনের জন্য দৃপ্ত পদক্ষেপে এগিয়ে এসেছেন জীবন বীমার কর্মক্ষেত্রে। তাদের ভূমিকা জীবন বীমার ক্ষেত্রে নি:সন্দেহে এক গৌরবময় ও বলিষ্ঠ সংযোজন। অন্যান্য উন্নয়নশীল দেশের জীবনবীমা প্রতিনিধিদের মতো তারাও একদিন প্রভূত যশ ও অর্থের অধিকারী হবেন- এই স্থির বিশ্বাস আমাদের রয়েছে।
আমেরিকায় তিন হাজারেরও বেশি জীবন বীমা প্রতিনিধি রয়েছেন যারা মিলিয়ন ডলার ক্লাবের সদস্য। কেবল এজেন্ট হিসেবে বছরে প্রায় চল্লিশ লক্ষ টাকার বীমা যিনি বিক্রয় করতে পারেন- তার পক্ষেই সম্ভব এ গৌরব অর্জন করা। আমাদের এই উপমহাদেশে উক্ত ক্লাবের দু’জন সদস্য রয়েছেন। একজন হচ্ছে করাচির আকবর খান। কয়েক বছর ধরে তিনি নিয়মিতভাবে একই ক্লাবের সদস্যপদ রক্ষা করে যাচ্ছেন। প্রতি বছর শুধু নতুন ব্যবসার কমিশন হিসেবেই তিনি হাজার হাজার টাকা রোজগার করেন। আকবর খান বীমা জগতের এক বিস্ময়। তিনি কোন কোম্পানি বা কর্পোরেশনের বড় কর্তা বা সংগঠক নন। তিনি একজন সাধারণ বীমাজীবী। তার জীবনের সাফল্যের মূল কারণ দু’টি- (ক) নিজের পেশাগত জ্ঞানের ওপর গভীর দখল এবং (খ) কঠোর পরিশ্রম। তার সাফল্যের কারণ জিজ্ঞেস করা হলে তিনি উত্তর দেন- “কারণ, কিছুই নয়, আমি বেশি লোকের সাথে সাক্ষাৎ করি”। এমনও দিন আছে আকবর খান কমপক্ষে ৩০-৩৫ জন নতুন লোকের সাথে সাক্ষাৎ করেন। পাকিস্তানের ইসহাক খান এই উপমহাদেশের বীমা জগতের আর একটি উজ্জল নক্ষত্র। তিনি একজন বীমা প্রতিনিধির ভূমিকায় নিজেকে অবতীর্ন করে অভূতপূর্ব সাফল্য অর্জন করেছেন। তিনিও মিলিয়ন ডলার ক্লাব এর একজন সদস্য। পেশাগত জ্ঞানে তিনি জ্ঞানবৃদ্ধ। নিয়মিতভাবে পড়াশোনা করা তার দৈনিক কর্মসূচির একটি বিশেষ অঙ্গ। ভারতের এক মহিলা জীবন বীমার প্রতিনিধি আহমেদাবাদের শ্রীমতী গিরা সারাবাঈ ১৯৭৩-৭৪ সালে দুই কোটি টাকার ওপর জীবন বীমার পলিসি বিক্রয় করে সমগ্র ভারতে জীবন বীমার প্রতিনিধিদের মধ্যে শীর্ষস্থান দখল করে একটি অত্যুজ্জ্বল রেকর্ড সৃষ্টি করেছেন। এ প্রতিষ্ঠাবান ব্যক্তিদের আদর্শ অনুসরণ করুন। আপনার সাফল্যও সুনিশ্চিত হবে।