বীমাখাতের উন্নয়ন: কে বাঁধবে ঘণ্টা?
এ কে এম এহসানুল হক:
অনেক কিছু করার ছিল কিন্তু করা হয়নি। বুকের ভিতর এক চাপা ব্যাথা যেন দুমড়ে দুমড়ে কাঁদছে। পাঠক আপনারা সঠিক অনুমান করতে পেরেছেন। এখানে বাংলাদেশ বীমা শিল্পের কথাই বলা হচ্ছে। স্বাধীনতার সুদীর্ঘ প্রায় পাঁচ দশক পর বাংলাদেশ বীমা শিল্প এক সম্মানজনক জায়গায় পৌঁছানোর কথা ছিল। আমরা স্বীকার করি বা না করি দুঃখজনকভাবে তা হয়নি। কেন হয়নি তার বিচার বিশ্লেষণ করা প্রয়োজন।
এর কারণ একাধিক। বীমা শিল্পের প্রতি শুরু থেকেই সরকারের অনীহা এবং কোন রকম গুরুত্ব আরোপ না করা। বিভিন্ন ইন্স্যুরেন্স সেমিনারে অর্থ মন্ত্রণালয় এবং বীমা কর্তৃপক্ষের উর্ধ্বতন কর্মকর্তাগণ অকপটে এ কথা স্বীকার করেন। এটা যেন একটা ফ্যাশনে দাঁড়িয়ে গেছে কিন্তু কার্যত তেমন কোন উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি দেখা যাচ্ছে না।
বর্তমান নৈরাজ্যজনক অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য চাই বাস্তবমুখী পদক্ষেপ গ্রহণ। আমলাতন্ত্র বীমা শিল্পের উন্নতির পথে এক প্রতিবন্ধকতা হয়ে দাঁড়িয়েছে। বীমা নিয়ন্ত্রক সংস্থায় যাদের নিয়োগ দেয়া হচ্ছে তাদের বেশিরভাগেরই বীমা বিষয়ে অভিজ্ঞতা নেই। এটা কর্মকর্তারা অকপটে স্বীকার করছেন। এমন অবস্থায় প্রশ্ন দাঁড়িয়েছে, যারা বীমা বোঝেন না তারা নিয়ন্ত্রক সংস্থার দায়িত্ব পেয়ে বীমার কতটা উন্নয়ন করবেন। তাদের নেয়া কোনো পদক্ষেপ উন্নয়নের চেয়ে যে ক্ষতিকর হবে না, সে আশঙ্কা দূর করবে কে।
সভা সমিতিতে সবাই সুন্দর সুন্দর কথা বলে কিন্তু কেউ কিছু করে না। সব সভাতেই হাজার সমস্যা নিয়ে আলোচনা হচ্ছে, অনিয়মন দুর্নীতিসহ সব ধরণের অপকর্মের কথা অকপটে স্বীকার করা হচ্ছে। এতে আসল সমস্যাটা যে কোথায় তা বোঝা কষ্টকর হয়ে যাচ্ছে। অনিয়মের কথা শুনতে শুনতে এমন অবস্থা দাঁড়াচ্ছে যে নিয়মটা যে কি, সেটা ভুলে যাওয়ার অবস্থা।
দ্বিতীয়ত বীমা শিল্পের জন্মলগ্ন থেকে যারা এ শিল্পের সাথে জড়িত ছিলেন বা অভিভাবকের ভূমিকা পালন করেছেন তাদের দূরদর্শিতার অভাব, নিষ্ক্রিয়তা, ব্যক্তিগত স্বার্থ ইত্যাদি আজকের বীমা শিল্পের দুঃখজনক অবস্থার জন্য অনেকটা দায়ি।
বীমা শিল্পের প্রচুর সংষ্কার প্রয়োজন। এ ব্যাপারে বিলম্ব করার অর্থ সময় নষ্ট করা। এমনিতেই অনেক সময় অতিবাহিত হয়ে গেছে। এখন দ্রুত সমস্যা সমাধানের সময় এসেছে। তা না হলে আমরা ভবিষ্যত প্রজন্মের কাছে দায়ি থাকব।
সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও তা বাস্তবায়নে ধীর এবং মন্থর গতির কারণে বাংলাদেশ বীমা শিল্প দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশের তুলনায় অনেক পিছিয়ে আছে। যত শীঘ্র সম্ভব এ অবস্থার পরিবর্তন আনা প্রয়োজন। পাশের দেশ ভারত এ ব্যাপারে অনেক ধাপ এগিয়ে গেছে। ভারতের জিডিপিতে বীমা শিল্পের অবদান শতকরা ৪ শতাংশ অথচ বাংলাদেশের জিডিপিতে বীমা শিল্পের অবদান মাত্র ০.৭০ শতাংশ। এর কারণ খুঁজে বের করা তেমন কঠিন কাজ নয়। আর সেটা হচ্ছে বীমা আইনের যথাযথ প্রয়োগ এবং বাস্তবায়ন। যে কোন কারণে হোক বীমা কর্তৃপক্ষের সিদ্ধান্ত গ্রহণ এবং বাস্তবায়নের ব্যাপারে তালবাহানা বা গড়িমসি করা যেন এক প্রকার অভ্যাসে দাঁড়িয়ে গেছে। বীমা শিল্প একাধিক সমস্যায় ভুগছে যা বীমা কর্তৃপক্ষের ঘুম নষ্ট হওয়ার জন্য যথেষ্ট।
আমাদের অতীতের ভুল, ভ্রান্তি ব্যর্থতা স্বীকার করে নিয়ে সামনের দিকে এগোতে হবে। পেছন ফিরে তাকানোর কোন সুযোগ বা অবকাশ নাই। এ ব্যাপারে আমাদের মানসিকতার আমূল পরিবর্তন প্রয়োজন। আমাদের বাস্তবের মুখোমুখি দাঁড়ানো সাহস অর্জন করতে হবে। বাস্তবকে অস্বীকার করা যেন নিজের অস্তিত্বকে অস্বীকার করা। সমস্যা যেমন আছে তেমনি তার সমাধানও আছে। ব্যক্তিগত স্বার্থের উর্ধ্বে উঠে সরকার, বীমা কর্তৃপক্ষ এবং বীমা শিল্পের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সকলকে নিস্বার্থ এবং নিরলসভাবে কাজ করতে হবে। তবেই বীমা শিল্পের উন্নয়ন সম্ভব, অন্যথায় নয়।
সবকিছু দেখে শুনে অনেকের মনে হয়তো এ ধারণা হতে পারে যে আমরা কি আদৌ পরিবর্ত আনতে আগ্রহী বা ইচ্ছুক? নিঃসন্দেহে কাউকে না কাউকে এ ব্যাপারে অধিক দায়িত্ব নিতে হবে। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে বিড়ালের গলায় ঘন্টা বাঁধবে কে?
লেখক: এ কে এম এহসানুল হক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক ডিগ্রিসহ মাস্টার্স ডিগ্রি অর্জন করেছেন। প্রায় চার দশক দুবাইয়ে অবস্থানকালে তিনি আন্তর্জাতিক খ্যাতি সম্পন্ন বিভিন্ন বীমা কোম্পানিতে চাকরি করেছেন।
এ সময় তিনি লন্ডন থেকে ফেলো অফ দি চাটার্ড ইন্স্যুরেন্স ইন্সটিটিউট (এফসিআইআই), এসোসিয়েটস অফ দি ইন্সটিটিউট অফ রিস্ক ম্যানেজমেন্ট (এআইআরএম) এবং এসোসিয়েট অফ দি চাটার্ড ইন্সটিটিউট অফ আরবিট্রেটরস (এসিআইআরবি) ডিগ্রি অর্জন করেন।
ইন্স্যুরেন্সের ওপর এ পর্যন্ত লেখকের অনেকগুলো বই প্রকাশিত হয়েছে, যা দেশে এবং বিদেশে সমাদৃত। পেশায় লেখক একজন চাটার্ড ইন্স্যুরার। বর্তমানে তিনি সরকারী ও বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতায় নিয়োজিত।
ইন্স্যুরেন্সনিউজবিডি'র পাঠকদের প্রয়োজনের দিকে লক্ষ্য রেখে বীমার গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো নিয়ে লিখেছেন এ কে এম এহসানুল হক।