বীমা জালিয়াতি ও আইডিআরএ’র ভূমিকা প্রসঙ্গে

কে এম এহসানুল হক, এফসিআইআই: সম্প্রতি ইন্স্যুরেন্স নিউজবিডি বীমার টাকা পেতে জালিয়াতি শীর্ষক একটি ধারাবাহিক সংবাদ প্রকাশ করেছে। সংবাদটিতে যে ঘটনার বিবরণ দেয়া হয়েছে বাংলাদেশে এ ধরনের ঘটনা আমার জানা মতে এটাই প্রথম। উন্নত বিশ্বে জালিয়াতি করে বীমা টাকার পেতে খুন, গুপ্তহত্যা মতো ঘটনার সংবাদ প্রায়ই পাওয়া যায়। জালিয়াতি ঠেকাতে তা তদন্ত ও অভিযুক্তদের আইনের আওতায় আনতে বিশ্বের ক্ষমতাধর দেশ আমিরিকাসহ অন্যান্য অনেক দেশে ইন্স্যুরেন্স ফ্রড ইন্টেলিজেন্ট এজেন্সি রয়েছে। আমার মনে হয়, বীমার টাকা পেতে একটি জুট মিলের জালিয়াতির যে প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে এটাই দেশের প্রকাশিত প্রথম ঘটনা। যা সত্যিকার অর্থেই দেশের বীমা খাতের ইতিহাসে নতুন একটি দিকের উন্মোচন করেছে।

দেশে বীমা কোম্পানিগুলো গ্রাহকের সাথে প্রতারণা করছে এমন অভিযোগ মারাত্মক রকম নেতিবাচক ধারণার সৃষ্টি করছে। দাবি পরিশোধ দ্রুত করতে আমরা গত কয়েকমাস আগেই দেখেছি পত্রিকায় গণশুনানির বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করতে হয়েছে। এমন একটি বাস্তবতায় একজন গ্রাহকের জালিয়াতি ঘটনা সত্যিকার অর্থেই ভিন্নমাত্রার সৃষ্টি করেছে।

সম্প্রতি অনেক ক্ষেত্রে বৈধ দাবির বেলায় বীমা কোম্পানি বীমাগ্রহীতার সঙ্গে সহযোগিতার পরিবর্তে নানা রকম ছল-চাতুরি ও বাহানা দেখিয়ে দাবি পরিহার বা নাকোচের ষড়যন্ত্রে মেতে উঠে; যা বীমাগ্রহীতার স্বার্থের পরিপন্থি।

কিন্তু বাস্তবে এ ক্ষেত্রে ঠিক তার উল্টোটাই ঘটেছে। এখানে বীমাগ্রহীতা ও সার্ভে কোম্পানি যোগসাজস করে ভাউচার জালিয়াতির মাধ্যমে বীমা কোম্পানির নিকট থেকে প্রকৃত ক্ষতির টাকার প্রায় দ্বিগুণ টাকা হাতিয়ে নেয়ার অপকৌশল ও অপপ্রয়াস চালিয়েছে। যা নজির বিহীন। শুধু বাংলাদেশেই নয় গোটা বিশ্বেই এমন ঘটনা খুজে পাওয়া মুসকিল।

বীমারা টাকা পেতে গ্রাহকের এমন জালিয়াতি ঘটনা বিবরণ নতুন চমক সৃষ্টি করলেও প্রশ্ন ওঠেছে নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের ভূমিকা নিয়ে। প্রতিবেদনগুলো জালিয়াতির এ ঘটনায় নিয়ন্ত্রণক সংস্থার ইন্ধনের সরাসরি যোগসূত্র তুলে ধরা হয়েছে। যা অত্যন্ত উদ্বেগের কারণ।

প্রতিবেদনে প্রকাশিত তথ্য অনুসারে, বীমা জরিপকারী, বীমা কর্তৃপক্ষ ও বীমা গ্রাহক এই তিনের সমন্বয়ে জালিয়াতির ঘটনা ঘটেছে। এখানে আরও বেশি উদ্বেগের বিষয় সার্ভেয়ার প্রতিষ্ঠানের সংশ্লিষ্টতা। সার্ভে কোম্পানিগুলো বীমার ক্ষয় ক্ষতির নিরুপণে বিচারকের ভূমিকা পালন করে থাকে। এই দিক থেকে চিন্তা করলে উল্লেখিত ঘটনায় সার্ভেয়ারের বিরুদ্ধে যে অভিযোগ তোলা হয়েছে তা আতঙ্কিত হওয়ার মতো।

তবে অভাবনীয় যে ঘটনা ঘটেছে তা হলো ভাউচার জালিয়াতির ঘটনায় নিয়ন্ত্রক সংস্থা বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রক কর্তৃপক্ষের সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ। অন্যান্য দেশে বীমা জালিয়াতির যে ঘটনা ঘটে তাতে নিয়ন্ত্রক সংস্থার সম্পৃক্ততা খুঁজে পাওয়া গেছে এমন ঘটনা বিরল। বরং নিয়ন্ত্রক সংস্থা জালিয়াতির চক্রের বিরুদ্ধে শাস্তিমুলক ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে এমনটাই দেখা যায়।

বীমা দাবির ক্ষয়ক্ষতি নিরুপণে বীমা কোম্পানি সার্ভেয়ার নিয়োগ করে। বীমা কর্তৃপক্ষ দ্বিতীয় সার্ভেয়ার নিয়োগ করে। এ ক্ষেত্রে বীমা কর্তৃপক্ষ দ্বিতীয় সার্ভেয়ারে রিপোর্টটি সঠিকভাবে তদন্ত না করে বীমা দাবি পরিশোধের জন্য বীমা কোম্পানিকে নির্দেশ প্রদান করে।

এক্ষেত্রে অভিযোগ করা হয়েছে, প্রথম সার্ভে রিপোর্ট না দেখেই ২য় সার্ভেয়ার নিয়োগ করা। একই সাথে ২য় সার্ভে রিপোর্টটি যাচাই বাছাই না করেই বীমা দাবি পরিশোধে নির্দেশ প্রদান। যা রিতিমতো বীমাখাতে বিস্ময়ের সৃষ্টি করেছে। 

বীমা খাতের উন্নয়নের স্বার্থ সংরক্ষণ করার জন্য সরকার বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ (আইডিআরএ) প্রতিষ্ঠা করেছে।

বীমা কর্তৃপক্ষ যথাযথভাবে তাদের দায়িত্ব পালন করবে এটাই স্বাভাবিক ও কাম্য। এ ব্যাপারে তাদের ব্যর্থতা বা অক্ষমতা বীমা সেক্টরের উন্নয়ন এবং বীমাগ্রাহকের স্বার্থ রক্ষা ব্যাহত হতে বাধ্য। আর সেটা হবে বীমা কর্তৃপক্ষের জন্য এক লজ্জাসকর ব্যাপার এবং পরাজয় বরনের সামিল।

বীমা বিষয়ে জ্ঞান থাকা কর্তৃপক্ষের জন্য সুবিধাজনক, কিন্তু জরুরি নয়। বীমা কর্তৃপক্ষ সদস্যদের অনেকেই অতীতে বিভিন্ন সরকারি প্রতিষ্ঠান ও মন্ত্রণালয়ের উচ্চ পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন। প্রশাসন চালানোর ব্যাপারে তারা দক্ষ ও অভিজ্ঞ। সেক্ষেত্রে ভাউচার জালিয়াতির মত একটি ঘটনা, যা সাধারণ চোখেই দৃশ্যমান তা তারা ধরতে পারবেন না এটা গ্রহণযোগ্য নয়।  বীমা সেক্টরে প্রশাসন চালানোর ব্যাপারে তাদের এমন ব্যর্থতা কোনোভাবেই বাঞ্চনীয় ও কাম্য নয়।

আশা করি, বীমা সেক্টরের বৃহত্তর স্বার্থে কর্তৃপক্ষ তাদের উপর ন্যস্ত দায়িত্ব পালনে যথেষ্ঠ সচেতন ও যত্নবান হবেন। আর এতেই বীমা সেক্টরের প্রকৃত কল্যাণ ও মঙ্গল নিহিত আছে।

লেখক: বীমা বিশেষজ্ঞ এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গেস্ট ফ্যাকাল্টি (ডিপার্টমেন্ট অব ব্যাংকিং এন্ড ইন্স্যুরেন্স)।