বিনিয়োগ বিধি লঙ্ঘন করে যেভাবে পরিচালিত হচ্ছে নর্দার্ন ইসলামী ইন্স্যুরেন্স
নিজস্ব প্রতিবেদক: পরিশোধিত মূলধনের শর্ত পূরণ করা হয়নি। লঙ্ঘন করা হয়েছে সরকারি সিকিউরিটিজ বন্ডের বিনিয়োগ বিধি। আবার জেড ক্যাটেগরিতে বিনিয়োগ করা হলেও মানা হয়নি ন্যূনতম বিনিয়োগের বিধান। এমন সব অভিযোগ উঠেছে বেসরকারি খাতের নন-লাইফ বীমা কোম্পানি নর্দার্ন ইসলামী ইন্স্যুরেন্সের বিরুদ্ধে।
বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের পরিদর্শন দলের প্রতিবেদনে এসব অভিযোগ উঠে এসেছে। গত বছরের ৩০ জুন এই প্রতিবেদন দাখিল করে পরিদর্শন দল। এর আগে ২১ মে কর্তৃপক্ষের দুই সদস্যের পরিদর্শন দলটি বিনিয়োগ সংক্রান্ত বিষয়সমূহ সরেজমিনে যাচাইয়ের জন্য নর্দার্ন ইসলামী ইন্স্যুরেন্সের প্রধান কার্যালয় পরিদর্শন করে।
পরিদর্শন প্রতিবেদনের তথ্য অনুসারে, সর্বশেষ হিসাব সমাপনী বছর ২০২৩ সালে নর্দার্ন ইসলামী ইন্স্যুরেন্সের পরিশোধিত মূলধনের পরিমাণ ৪২ কোটি ৬৬ লাখ টাকা। মোট সম্পদের পরিমাণ ২৬৪ কোটি ৩৪ লাখ টাকা। এর মধ্যে বিনিয়োগযোগ্য সম্পদের পরিমাণ ২৬৪ কোটি ৩ লাখ টাকা। তবে বিনিয়োগ রয়েছে ১৪৯ কোটি ৯৮ লাখ টাকা।
নর্দার্ন ইসলামী ইন্স্যুরেন্স পিএলসি ২০১৯ সালে নাম পরিবর্তন করে ইসলামী শরীয়া ভিত্তিক বীমা ব্যবসা শুরু করে। এর আগে বীমা কোম্পানিটির নাম ছিল ‘নর্দার্ন জেনারেল ইন্স্যুরেন্স’।
আইডিআরএ’র পরিদর্শন দলের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে-
নর্দার্ন ইসলামী ইন্স্যুরেন্সের উদ্যোক্তা অংশের পরিশোধিত মূলধনের পরিমাণ ১৪ কোটি ৩২ লাখ টাকা; যা মোট পরিশোধিত মূলধনের ৩৩.৫৬%। এক্ষেত্রে পরিশোধিত মূলধনে উদ্যোক্তা অংশ এবং জনসাধারণ অংশের ৬০:৪০ অনুপাত সংরক্ষিত হয়নি এবং উদ্যোক্তা অংশের পরিশোধিত মূলধনে ৯ কোটি ৬৮ লাখ টাকা ঘাটতি রয়েছে।
নন-লাইফ বীমাকারীর সম্পদ বিনিয়োগ ও সংরক্ষণ প্রবিধানমালা ২০১৯ অনুসারে নর্দার্ন ইসলামী ইন্স্যুরেন্সের প্রকৃত বিনিয়োগের পরিমাণ ন্যূনতম বিনিয়োগ বিধির চেয়ে ৭ কোটি ৩০ লাখ টাকা কম রয়েছে। পরিদর্শন দলের হিসাব অনুসারে কোম্পানিটির বিনিয়োগ থাকার কথা ১৫৭ কোটি ২৮ লাখ টাকা। অথচ কোম্পানিটির মোট বিনিয়োগ আছে ১৪৯ কোটি ৯৮ লাখ টাকা।
অপরদিকে সরকারি সিকিউরিটিজ বন্ডে অন্যূন ৭.৫০% বিনিয়োগ করার আইনী বাধ্যবাধকতা থাকলেও কোম্পানিটি এ খাতে নির্ধারিত সীমার চেয়ে ১.০৭% তথা ২ কোটি ৮১ লাখ টাকা কম বিনিয়োগ করেছে। এই হিসাব করা হয়েছে কোম্পানিটির বিনিয়োগযোগ্য সম্পদের পরিমাণ ২৬৪ কোটি ৩ লাখ টাকার সাথে সাধারণ বীমা করপোরেশনের কাছে প্রাপ্য এবং অগ্রিম ভ্যাট-ট্যাক্সের মোট ৮৮ কোটি ৯৭ লাখ টাকা অন্তর্ভুক্ত করে।
আইন লঙ্ঘন করে জেড ক্যাটেগরিতে বিনিয়োগ করেছে নর্দার্ন ইসলামী ইন্স্যুরেন্স। কোম্পানিটি জেড ক্যাটাগরিভুক্ত ২টি শেয়ারে মোট বিনিয়োগের পরিমাণ ১৭ হাজার ২১৭ টাকা। এছাড়াও বি ক্যাটাগরিভুক্ত ২টি শেয়ারে মোট ২ হাজার ১৬৫ টাকা বিনিয়োগ করেছে নর্দার্ন ইসলামী ইন্স্যুরেন্স।
আবার এ-ক্যাটাগরির নিচে ৫টি ব্যাংকে স্থায়ী আমানত রেখেছে নর্দার্ন ইসলামী ইন্স্যুরেন্স, যা কোম্পানিটির জন্য ঝুঁকিপূর্ণ। ৩৭টি এফডিআর এর মাধ্যমে ২ কোটি ৬৯ লাখ টাকা বিনিয়োগ করেছে এ-ক্যাটাগরির নিচে। এক্ষেত্রে এ-ক্যাটাগরির নিচের বিনিয়োগ করে কোম্পানিটি নন-লাইফ বীমাকারীর সম্পদ বিনিয়োগ ও সংরক্ষণ প্রবিধানমালা, ২০১৯ লঙ্ঘন করেছে।
বিনিয়োগ প্রবিধি লঙ্ঘন করায় নর্দার্ন ইসলামী ইন্স্যুরেন্সের বিরুদ্ধে নিয়ন্ত্রক সংস্থাকে ৫টি পদক্ষেপ নেয়ার সুপারিশ করা হয় সম্পদ ও বিনিয়োগ সংক্রান্ত তদন্ত প্রতিবেদনে। এসব সুপারিশের মধ্যে রয়েছে-
নন-লাইফ বীমাকারীর সম্পদ বিনিয়োগ ও সংরক্ষণ প্রবিধানমালা অনুসারে নূন্যতম বিনিয়োগের ঘাটতি পূরণ এবং তা সবসময় সংরক্ষণ করার নির্দেশ প্রদান করা। সরকারি সিকিউরিটিজে অন্যূন ৭.৫০% বিনিয়োগের নির্দেশনা প্রদান করা। জেড ক্যাটাগরিভুক্ত শেয়ারে বিনিয়োগ করায় বীমা আইন ২০১০ অনুসারে ব্যবস্থা গ্রহণ করা।
‘এ’ ক্যাটাগরির নিচের ব্যাংকে এফডিআর-এ বিনিয়োগ করার জন্য কোম্পানির বিরুদ্ধে বীমা আইন ২০১০ অনুসারে ব্যবস্থা গ্রহণ করা এবং পরিশোধিত মূলধনের উদ্যোক্তা অংশের ঘাটতির বিষয়ে পর্যালোচনা করে কোম্পানির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করার সুপারিশ করা হয় তদন্ত প্রতিবেদনে।
এসব বিষয়ে নর্দার্ন ইসলামী ইন্স্যুরেন্সের এসিসট্যান্ট ভাইস-প্রেসিডেন্ট (অর্থ ও হিসাব) বিদ্যুৎ কুমার সমাদ্দার ইন্স্যুরেন্স নিউজ বিডি’কে বলেন, বিনিয়োগ সংক্রান্ত তদন্ত প্রতিবেদনে উত্থাপিত সকল অভিযোগ নিষ্পত্তি করা হয়েছে। এসব বিষয়ে আমাদের বক্তব্য লিখিভাবে আইডিআরএ’কে জানানো হয়েছে। নতুন করে আমাদের আর কিছু বলার নেই।
বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের উপ-পরিচালক ও মুখপাত্র মো. সোলায়মান এ বিষয়ে বলেন, বিনিয়োগের বিধান না মানায় নর্দার্ন ইসলামী ইন্স্যুরেন্সকে জরিমানা করা হয়েছে। একইসঙ্গে কোম্পানিটিকে প্রয়োজনীয় বিধি-বিধান পরিপালন করতে বলা হয়েছে। নতুন করে কোন অনিয়ম করলে প্রয়োজনীয় আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হবে।