এক্সপ্রেস ইন্স্যুরেন্সের এজেন্টদের ব্যাংক একাউন্টে জমা হয় লাখ লাখ টাকা, আয় হিসেবে প্রদর্শন না করার অভিযোগ
নিজস্ব প্রতিবেদক: পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত এক্সপ্রেস ইন্স্যুরেন্স লিমিটেড ২০২২ সালে এজেন্ট কমিশন দিয়েছে ৭ কোটি ৩৪ লাখ টাকা। এই টাকা পরিশোধ করা হয়েছে ৩২ জন এজেন্টের ব্যাংক একাউন্টে। যাদের মধ্যে ২২ জনই নারী। এই হিসাবে গড়ে প্রতিজন এজেন্টের বার্ষিক আয় ২২ লাখ ৯২ হাজার টাকা। এজেন্টদের মোটা অংকের এই আয়ের হিসাব তারা কোথাও প্রদর্শন করেন না বলে অভিযোগ রয়েছে।
এই মোটা অংকের কমিশন আয়ের বিষয়ে এজেন্টদের সাথে কথা বলা হয় তাদের মোবাইল ফোনে। এই কথোপকথনে জানা যায়, এক্সপ্রেস ইন্স্যুরেন্সের অধিকাংশ নারী এজেন্টের স্বামী বা নিকটাত্মীয় কোম্পানিটির ব্রাঞ্চ ইনচার্জ। তারাই এসব এজেন্টের ব্যাংক একাউন্ট পরিচালনা করেন বলে অভিযোগ রয়েছে।
এই আলাপে তারা জানায়, এজেন্টদের ব্যাংক একাউন্টে টাকা জমা হলেও এই টাকা তাদের আয় নয়। এই টাকা তারা ব্যবসা সংগ্রহের জন্য গ্রাহকদের দিয়ে দেন বলে দাবি করেন তারা। এ কারণে এজেন্ট কমিশনের অর্থ তারা আয়কর নথি বা অন্য কোথাও প্রদর্শন করেন না।
এক্সপ্রেস ইন্স্যুরেন্সের প্রধান কার্যালয়সহ ২৪টি ব্রাঞ্চের এজেন্ট তালিকায় থাকা মোট ৩৯ জনের সাথে কথা বলার চেষ্টা করে ইন্স্যুরেন্স নিউজ বিডি। এর মধ্যে ১০ জন এজেন্টের সাথে আলাপ করা সম্ভব হয়। তাদেরই একজন নার্গিস আখতার।
বীমা কোম্পানিটির নারায়ণগঞ্জ ব্রাঞ্চের এজেন্ট তালিকায় নাম রয়েছে নার্গিস আখতারের। তার মোবাইল নম্বরে কল করা হলে কলটি রিসিভ করেন কবির খন্দকার। তিনি নিজেকে নার্গিস আখতারের স্বামী হিসেবে পরিচয় দেন। একইসঙ্গ তিনি নিজেকে এক্সপ্রেস ইন্স্যুরেন্সের নারায়ণগঞ্জ ব্রাঞ্চের ইনচার্জ ও কোম্পানিটির এডিশনাল ম্যানেজিং ডিরেক্টর হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন বলে জানান।
কবির খন্দকার বলেন, তার স্ত্রী নার্গিস আখতার এক্সপ্রেস ইন্স্যুরেন্সের নারায়ণগঞ্জ ব্রাঞ্চের একমাত্র এজেন্ট। বীমা সম্পর্কে প্রশিক্ষণ দিয়ে তার নামে এজেন্ট লাইসেন্স নেয়া হয়েছে নিয়ন্ত্রক সংস্থা থেকে। এজেন্ট লাইসেন্স নবায়ন করার জন্যও প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ নেন নার্গিস আখতার।
তবে নার্গিস আখতার কোন বীমা পলিসি বিক্রি করেন না। সবই করেন কবির খন্দকার ও কোম্পানির উন্নয়ন কর্মকর্তারা। তবে এই ব্রাঞ্চের সকল পলিসির কমিশন দেয়া হয় নার্গিস আখতারের ব্যাংক একাউন্টে। পরে প্রয়োজন মতো সেই টাকা তুলে দেয়া হয় বীমা গ্রাহকদের।
বর্তমানে নার্গিস আখতার অসুস্থ। ২০২০ সালে তার ক্যান্সার ধরা পরার পর থেকেই চিকিৎসা চলছে বলে জানান কবির খন্দকার।
নার্গিস আখতারের নামে ২০২২ সালে ৭৭ লাখ ৮৯ হাজার ৫৪ টাকার এজেন্ট কমিশন প্রদান করেছে এক্সপ্রেস ইন্স্যুরেন্স। এই হিসাবে এজেন্ট কমিশন বাবদ নার্গিস আখতারের মাসিক আয় গড়ে ৬ লাখ ৪৯ হাজার ৮৮ টাকা। তবে এই টাকা তার আয় হিসেবে প্রদর্শন করা হয় না। কারণ, ব্যবসা সংগ্রহের জন্য সব টাকাই গ্রাহকদের দিয়ে দিতে হয় বলে দাবি কবির খন্দকারের।
তিনি আরো জানান, এক্সপ্রেস ইন্স্যুরেন্সের প্রায় সবগুলো ব্রাঞ্চেই একজন করে এজেন্ট রয়েছে এবং তিনি ওই ব্রাঞ্চের ইনচার্জের স্ত্রী অথবা নিকটাত্মীয়। কোম্পানির সিএফও’র সাথে কথা বললে এ বিষয়ে আরো বিস্তারিত জানা যাবে বলেও উল্লেখ করেন কবির খন্দকার।
নিজের পরিচয় সম্পর্কে কবির খন্দকার জানান, ২০০০ সালে তিনি এক্সপ্রেস ইন্স্যুরেন্সে যোগদান করেন। পদোন্নতি পেয়ে এখন তিনি কোম্পানিটির এডিশনাল ম্যানেজিং ডিরেক্টর। কবির খন্দকার এর আগে কর্মরত ছিলেন সিটি ইন্স্যুরেন্সে। ১৯৯৬ সালে কোম্পানিটিতে যোগদানের মাধ্যমে তিনি বীমা পেশায় কর্মজীবন শুরু করেন।
এক্সপ্রেস ইন্স্যুরেন্সের আরেক এজেন্ট সৈয়দ জাহানারা আকতার। কোম্পানিটির প্রধান কার্যালয়ের অধীনে তিনি বীমা ব্যবসা করেন। যোগাযোগ করা হলে তিনি জানান, অনেক দিন ধরেই তিনি এক্সপ্রেস ইন্স্যুরেন্সের সাথে আছে। তবে কি হিসেবে আছেন- জানতে চাইলে কোন উত্তর দেননি।
২০২২ সালে মোট ৫৬ লাখ ৬৮ হাজার ৬৮৫ টাকার এজেন্ট কমিশন পেয়েছেন কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, এভাবে কিছু বলতে পারব না; দেখতে হবে। আমি এখন একটা কাজে ব্যস্ত আছি। পরে কথা বলতে হবে। তবে কখন কথা বলতে পারবেন তা জানতে চাইলে ফোন কেটে দেন সৈয়দ জাহানারা আকতার।
এক্সপ্রেস ইন্স্যুরেন্সের এজেন্ট তালিকায় কাওরান বাজার ব্রাঞ্চে মোট এজেন্ট দেখানো হয়েছে ১ জন। ওই এজেন্টের নাম শরীফুন-নেসা। তালিকায় থাকা মোবাইল নম্বরে কল দিলে নম্বরটি বন্ধ পাওয়া যায়।
তবে কোম্পানির ওয়েবসাইটে ব্রাঞ্চের তথ্য তালিকায় দেয়া মোবাইল নম্বরে কল করলে কবির উজ-জামান নামের একজন কল রিসিভ করেন। নিজেকে তিনি পরিচয় দেন এক্সপ্রেস ইন্স্যুরেন্সের কাওরান বাজার ব্রাঞ্চের ইন-চার্জ হিসেবে।
ব্রাঞ্চটিতে মোট এজেন্ট কতজন জানতে চাইলে তিনি বলেন, একজন এজেন্ট রয়েছে; নাম শরীফুন-নেসা। তার সাথে সম্পর্ক কি জানতে চাইলে কবির উজ-জামান বলেন, তিনি (শরীফুন-নেসা) আমার স্ত্রী। বর্তমানে অসুস্থ হয়ে তিনি হাসপাতালে ভর্তি।
কবির উজ-জামান নিজেও হাসপাতালে আছেন উল্লেখ করে পরে কথা বলতে হবে বলে ফোন কেটে দেন।
এক্সপ্রেস ইন্স্যুরেন্সের কাকরাইল ব্রাঞ্চে মোট দু’জন বীমা এজেন্ট রয়েছে। একজন হলেন অনিন্দ জামান লস্কর। ২০২২ সালে অনিন্দ জামান লস্করের নামে এজেন্ট কমিশন প্রদান করা হয় ২৪ লাখ ১৯ হাজার টাকা।
এ বিষয়ে জানতে অনিন্দ জামান লস্করের সাথে কথা হয় মোবাইল ফোনে, জানতে চাওয়া হয় এজেন্ট কমিশন সম্পর্কে। তবে সাংবাদিক পরিচয় পাওয়ার পর তিনি কথা বলতে অপারগতা প্রকাশ করেন এবং ফোনকল কেটে দেন।
২০২২ সালে এক্সপ্রেস ইন্স্যুরেন্সের সর্বোচ্চ এজেন্ট কমিশন পরিশোধ দেখানো হয় কাকরাইল ব্রাঞ্চের বীমা এজেন্ট মো. জহির উদ্দিন লস্করের নামে। তাকে মোট ১ কোটি ১ লাখ ৬৮ হাজার টাকার এজেন্ট কমিশন প্রদান করা হয়, যা ওই বছরে কোম্পানিটির মোট এজেন্ট কমিশনের ১৩.৮৬ শতাংশ।
এজেন্ট তালিকায় থাকা জহির উদ্দিন লস্করের মোবাইল নম্বরে কল করলে কলটি রিসিভ করেন এক্সপ্রেস ইন্স্যুরেন্সের বর্তমান মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা বদিউজ্জামান লস্কর। মোবাইল নম্বরটি জহির উদ্দিন লস্করের কিনা জানতে চাইলে বদিউজ্জামান লস্কর বলেন, এটি আমার মোবাইল নম্বর।
এজেন্ট তালিকায় থাকা জহির উদ্দিন লস্করের নামে এই মোবাইল নম্বর দেয়া কেন তা জানতে চাইলে বদিউজ্জামান লস্কর বলেন, জহির উদ্দিন লস্করের ব্যাংক একাউন্টটি আমার ম্যানডেড দেয়া বা ক্ষমতা প্রদান করা তাই আমার মোবাইল নম্বর ব্যবহার করা হয়েছে। জহির উদ্দিন লস্করের নামে দেয়া এজেন্ট কমিশনের বিষয়ে জানতে চাইলে আর কোন কথা বলতে চাননি কোম্পানিটির মুখ্য নির্বাহী বদিউজ্জামান লস্কর।
উল্লেখ্য, ২০২২ সালের নিরীক্ষা প্রতিবেদন অনুসারে এক্সপ্রেস ইন্স্যুরেন্সের প্রধান কার্যালয়ের বাইরে মোট ২৪টি শাখা কার্যালয় রয়েছে। কোম্পানিটিতে মোট এজেন্ট রয়েছে ৩৯ জন, যার মধ্যে ২২ জনই নারী। এই ৩৯ জন এজেন্টের মধ্যে ৩২ জন এজেন্টকে কমিশন দেয়া হয়েছে মোট ৭ কোটি ৩৩ লাখ ৪৬ হাজার টাকা। এর মধ্যে ১৮ জন নারী এজেন্টকে কমিশন দেয়া হয়েছে ৩ কোটি ৭৩ লাখ ৮০ হাজার টাকা।
এক্সপ্রেস ইন্স্যুরেন্সের এমন কর্মকাণ্ডের বিষয়ে বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের পদক্ষেপ কি হতে পারে তা জানতে সংস্থাটির মিডিয়া এন্ড কমিউনিকেশন পরামর্শক ও মুখপাত্র সাইফুন্নাহার সুমির সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি বিষয়টি জেনে জানাবেন বলে উল্লেখ করেন।
আইন যা বলছে:
ব্যবসা সংগ্রহের উদ্দেশ্যে কমিশন কিংবা অন্য কোন প্রকার পারিশ্রমিক পরিশোধে বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়েছে বীমা আইন ২০১০ এর ৫৮(১) ধারায়। এখানে বলা হয়েছে, কোন ব্যক্তি বাংলাদেশে বীমা ব্যবসা অর্জন বা সংগ্রহের উদ্দেশ্যে বীমা এজেন্ট বা এজেন্ট নিয়োগকারী বা ব্রোকার ব্যতীত অন্য কাউকে কমিশন বা অন্য কোন নামে কোন পারিশ্রমিক বা পারিতোষিক পরিশোধ করবে না বা প্রদান করার জন্য কোন চুক্তি করবে না।
বীমা চুক্তি সম্পাদনে প্রলুদ্ধ করার জন্য বিভ্রান্তিকর বিবরণী, আশ্বাস বা পূর্বাভাস দেয়ার বিষয়ে বীমা আইন ২০১০ এর ১৩৩ ধারায় বলা হয়েছে-
কোন ব্যক্তি বিভ্রান্তিকর, মিথ্যা বা প্রতারণামূলক বলিয়া জানেন, এরূপ বিবরণী, আশ্বাস, পূর্বাভাস দ্বারা, বা প্রতারণামূলক বলে জানেন বা প্রতারণামূলক পূর্বাভাষ দ্বারা কোন ব্যক্তিকে কোন বীমাকারীর সাথে বীমা চুক্তি সম্পাদনের প্রস্তাবে প্রলুদ্ধ করার চেষ্টা করলে তিনি এই অপরাধে অভিযুক্ত হবেন এবং অভিযোগ প্রমাণিত হলে অনধিক ১০ লাখ টাকা অর্থ দণ্ড বা অনধিক ৩ বৎসরের কারাদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন৷
অপরদিকে আয় গোপন করার জন্য জরিমানা আরোপ করা হয়েছে আয়কর আইন, ২০২৩-এ।
এই আইনের ২৭২(১) ধারায় বলা হয়েছে- এই আইনের অধীন কোনো কার্যক্রম চলাকালে, কার্যক্রম পরিচালনাকারী কর্তৃপক্ষ যদি এই মর্মে সন্তুষ্ট হয় যে, কোনো ব্যক্তি, উক্ত কার্যক্রমে কিংবা একই আয়বর্ষের কর নির্ধারণ সম্পর্কিত পূর্ববর্তী কোনো কার্যক্রমে তার আয়, সম্পদ, দায়, ব্যয়ের তথ্য বা অন্য কোনো গুরুত্বপূর্ণ তথ্য যা করদাতার প্রদেয় অঙ্কের সাথে সম্পর্কযুক্ত তা অসত্য পরিমাণে প্রদর্শনের মাধ্যমে এই আইনের অধীন প্রদেয় অঙ্কের ফাঁকি দিয়েছেন, তা হলে উক্ত কার্যক্রম পরিচালনাকারী কর্তৃপক্ষ উক্ত ব্যক্তির উপর ক+খ এর সমপরিমাণ জরিমানা আরোপ করবে,
এক্ষেত্রে- ক = ফাঁকি দেয়া অঙ্ক × ১৫%, খ = ফাঁকি দেয়া অঙ্ক × ১০%× গ, গ = অসত্য পরিমাণে তথ্য প্রদর্শনের বিষয়টি যেই করবর্ষে সংঘটিত হয়েছে সেই করবর্ষ হতে উক্ত অসত্য পরিমাণে তথ্য প্রদর্শনের বিষয়টি যেই করবর্ষে উদঘাটিত হয়েছে সেই করবর্ষ পর্যন্ত মোট বৎসর।
এদিকে খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বীমা এজেন্টদের এই লাখ লাখ টাকার কমিশন তাদের আয় হিসেবে প্রদর্শন না করার বিষয়টি মানিলন্ডারিং অপরাধের মধ্যে পড়ে কিনা সে বিষয়টিও ক্ষতিয়ে দেখা এবং প্রয়োজনীয় আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা দরকার সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের। অন্যথায় আইন লঙ্ঘনসহ এ ধরণের অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড আরো বাড়তে পারে বীমা খাতে।