ঘুষ না দেয়ায় মৃত্যুদাবি নাকোচ করেছে সানফ্লাওয়ার লাইফ
মোস্তাফিজুর রহমান টুংকু: ঘুষের পুরো টাকা না দেয়ায় মায়ের মৃত্যুদাবির আবেদন নাকোচ করেছে বেসরকারি লাইফ বীমা কোম্পানি সানফ্লাওয়ার লাইফ ইন্স্যুরেন্স। এমনটাই অভিযোগ করেছেন সানফ্লাওয়ার লাইফের বীমা গ্রাহক মৃত পারভীন আক্তারের মেয়ে ও পলিসির নমিনি শারমিন আক্তার। গতকাল মোবাইল ফোনে ইন্স্যুরেন্সনিউজবিডি'র কাছে এমন অভিযোগ করেন তিনি।
শারমিন আক্তার বীমা দাবি আদায়ে বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের কাছেও লিখিতভাবে এ অভিযোগ করেছেন বলে জানান।
শারমিন আক্তারের বাড়ি কুমিল্লার লাকসামে। বর্তমানে বিএ পড়ছেন। এক ভাই এক বোনের সংসার। ভাই ঢাকায় একটি কলেজে পড়েন। বাবা মালয়েশিয়া প্রবাসী।
শারমিন অভিযোগ করেন, সানফ্লাওয়ার লাইফ ইন্স্যুরেন্সের দাবি বিভাগের ইনচার্জ মিজানুর রহমান ও সহকারি খালেদ সাইফুল্লাহ দাবিটি তদন্তে এসে তার কাছে ৫০ হাজার টাকা দাবি করেন। এ টাকা দিলে দাবির টাকা দ্রুত পাবেন বলে জানান তারা। অভাবের সংসারে টাকার প্রয়োজনে ওই দুই কর্মকর্তার কথায় শারমিন ১০ হাজার টাকা দেন। এ টাকা মিজানুর ও সাইফুল্লাহ কুমিল্লা থেকে ঢাকা যাওয়ার পথে লাকসামে গাড়ি থামিয়ে নেন।
পরে বাকি টাকা না দেয়ায় মিথ্যা অভিযোগ এনে দাবিটি নাকোচ করেন। তবে দাবি নাকোচ করার পর দুই দফায় ওই দুই কর্মকর্তা ৫ হাজার করে ১০ হাজার টাকা ফেরত দেন। এই টাকা তারা ফেরত দেন বিকাশে। গত ২০ মে বিকাশ নম্বর ০১৯১২৬৫২০২৬-তে তারা এ টাকা ফেরত দেন। এসময়েই তারা জানান বীমা দাবির টাকা পাবেন না।
শারমিন অভিযোগ করেন, ঘুষের পুরো টাকা না দিতে না পারায় তারা আমার মায়ের বীমা দাবি দিচ্ছে না। আমার মা হার্ট এট্যাকে মারা গেছেন। হাসপাতালের মৃত্যসনদে মৃত্যর কারণ হিসেবে তাই বলা হয়েছে। অথচ আমার মায়ের জরায়ুতে ক্যান্সার ছিল এমন অভিযোগ এনে দাবি নাকোচ করা হয়েছে। যার কোনো ভিত্তি নেই।
শারমিনের অভিযোগ, তার পাশ্ববর্তী এলাকাতেও একজনের মৃত্যুদাবি দিতে ২০ হাজার টাকা নিয়েছে সানফ্লাওয়ারের কর্মকর্তারা।
শারমিন আরো জানান, আইডিআরএ’র কাছে অভিযোগ করার পর গত ৮ জুলাই বীমা কোম্পানিকে ৫ কার্যদিবসের মধ্যে ব্যাখ্যা দিতে চিঠি দিয়েছে। ওই চিঠির একটি অনুলিপি দেয়া হয়েছে শারমিনকে। পরে বীমা কোম্পানিটির মূখ্য নির্বাহী শামসুল আলম গত বুধবার শারমিনকে ডেকে পাঠান। তার কথা অনুযায়ী শারমিন দেখা করলে বীমা দাবির টাকা দিবেন বলে জানিয়েছেন ওই মূখ্য নির্বাহী।
এদিকে গত বৃহস্পতিবার আইডিআরএ থেকে শারমিনকে ফোন করে জানতে চায়, ঢাকায় আসতে পারবেন কি না। তবে শারমিন জানিয়ে দিয়েছেন তিনি যেতে পারবেন না।
সানফ্লাওয়ার লাইফের অপর একটি সূত্র জানায়, আইডিআরএ থেকে সানফ্লাওয়ার লাইফকে শোকজ করার পর নামেমাত্র টাকা দিয়ে বিষয়টি মিমাংসা করার চেষ্টা করা হচ্ছে। কোম্পানির মূখ্য নির্বাহী লাকসামের স্থানীয় কর্মকর্তাদের নির্দেশ দিয়েছেন অল্প টাকা পয়সা দিয়ে দাবিটি নিষ্পত্তি করার।
শারমিন ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, আমি কুমিল্লায় বীমা করেছি। এখন কোম্পানির দুর্নীতির জন্য আমাকে টাকা তুলতে ঢাকা কেন যেতে হবে। তাহলে বীমা গ্রাহকরা কিভাবে বীমার প্রতি আগ্রহী হবে। আইডিআরএ তদন্ত করে এ বিষয়ে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারে। আমাকে যদি বারবার ঢাকায় যেতে হয় তাহলে তো আবার সেই হয়রানি। গত এক বছর ধরে কোম্পানি নানাভাবে হয়রানি করছে। আর হয়রানি হতে চাই না। আমি সুষ্ঠু বিচার চাই।
শারমিন আক্তার জানান. বীমা গ্রাহক মৃত পারভীন আক্তার বীমা পলিসিটি করেন ১৮ মে ২০১৭ তারিখে। এরপর গত ১০ জুন ২০১৭ তারিখে পারভীন আক্তারের হার্ট এট্যাক হলে স্থানীয় লাকসাম ফেয়ার হেলথ হাসপাতালে মারা যান। হাসপাতালে নেয়ার পর পারভীন আক্তারকে মৃত ঘোষণা করেন কর্তব্যরত ডাক্তাররা।
পরে হাসাপাতালের কর্তব্যরত ডাক্তারদের বিরুদ্ধে পারভীন আক্তারের চিকিৎসায় দায়িত্ব অবহেলার অভিযোগ তোলা হলে স্থানীয় জনগণ ক্ষুদ্ধ হয়ে হাসপাতালে ভাংচুর করে। পরে দায়িত্ব অবহেলায় প্রমাণ পাওয়ায় হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ ৫ লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ দেন।
প্রিমিয়াম জমার মানি রিসিপট, আইডিআরএ’র কাছে দাখিল করা অভিযোগ ও সানফ্লাওয়ার লাইফের পাঠানো চিঠিপত্রের তথ্য অনুসারে, গত ১০ জুন ২০১৭ তারিখে পারভীন আক্তার মারা যাওয়ার পর গত ২ জুলাই ২০১৭ তারিখে দাবি জন্য আবেদন করা হয়। ওই আবেদনের প্রেক্ষিতে চাহিদাপত্র দিয়ে সানফ্লাওয়ার লাইফ শারমিনকে চিঠি দেয় ১৬ আগষ্ট ২০১৭ তারিখে। চাহিদাপত্র অনুসারে প্রয়োজনীয় কাগজপত্র সানফ্লাওয়ার লাইফে পাঠানো হয় ১০ সেপ্টেম্বর ২০১৭ তারিখে।
এর তিন মাস পর চলতি গত ৭ জানুয়ারি দাবিটি নাকোচ করে পত্র দেয়া হয়। পরে দাবিটি পুনরায় তদন্ত করে পরিশোধের জন্য গত ১৭ জানুয়ারি আবারো সানফ্লাওয়ার লাইফের কাছে আবেদন করেন শারমিন। এরপরও কোনো ব্যবস্থা না নেয়ায় গত ৪ এপ্রিল আইডিআরএ’র কাছে অভিযোগ দাখিল করেন শারমিন।
এ বিষয়ে সানফ্লাওয়ার লাইফের মূখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) মো. শামসুল আলম বলেন, ঘুষ গ্রহণের ঘটনা সত্য এবং এরইমধ্যে ঘুষের টাকা ফেরতও দেয়া হয়েছে। কোম্পানির দাবি বিভাগের ইনচার্জ মিজানুর রহমান ও সহকারি খালেদ সাইফুল্লাহ ঘুষ গ্রহণের সঙ্গে জড়িত। তবে মিজানুর রহমান কোম্পানির চেয়ারম্যানের ভাগ্নি জামাই হওয়ার দ্রুত ও যথাযথ ব্যবস্থা নিতে কিছুটা সমস্যা হচ্ছে। তারপরও আমরা বিষয়টি তদন্তে কমিটি গঠন করেছি। অভিযুক্তকে শোকজ করা হয়েছে এবং ওই বিভাগ থেকে তাকে সরিয়ে নেয়া হয়েছে। দাবি পরিশোধের বিষয়টিও আমার বিবেচনায় আছে, বলেন শামসুল আলম।