ইঞ্জিনিয়ারিং ইন্স্যুরেন্স

এ কে এম এহসানুল হক:

১৮০০ এবং ১৯০০ সালে শিল্প বিপ্লব সংগঠিত হয়। তার পরিণতি হিসেবে কলকারখানায় ব্যবহারের জন্য বহু ধরণের যন্ত্রপাতি আবিষ্কৃত হয়। শিল্প বিপ্লবের পূর্বে ইউরোপের অর্থনীতি মূলত কৃষিকাজের উপর নির্ভরশীল ছিল। শিল্প বিপ্লব এক দিকে যেমন মানুষের জন্য কল্যাণ বয়ে আনে তেমনি দুর্ঘটনার কবল থেকে মূল্যবান যন্ত্রপাতি রক্ষার ব্যাপারটিও চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়ায়।

গৃহ কাজের জন্য ব্যবহৃত বয়লার ঘন ঘন বিস্ফোরণের ফলে সম্পত্তি ও জানমালের ক্ষতি রোধ করার জন্য ১৮৮২ সালে বয়লার বিস্ফোরণ আইনের মাধ্যমে বাৎসরিক বয়লার পরিদর্শন বাধ্যতামূলক করা হয়। পরবর্তীতে বিধিবদ্ধ আইনের মাধ্যমে উত্তোলন যন্ত্রপাতির বাৎসরিক পরিদর্শন বাধ্যতামূলক করা হয়।

১৯৫৪ সালে বয়লার বীমার হাত ধরে ইঞ্জিনিয়ারিং বা কারিগরী বীমার যাত্রা শুরু। সময়ের সাথে সাথে এবং ব্যবসার প্রয়োজনে ধীরে ধীরে বয়লার বীমার সঙ্গে বিভিন্ন প্রকার কারিগরী বীমা তালিকাভুক্ত করা হয়।

ইঞ্জিনিয়ারিং বা কারিগরী বীমার প্রকারভেদ:

১. বয়লার বীমা (প্রাচীনতম কারিগরী বীমা)

২. কন্ট্রাক্টর’স অল রিস্ক বা ঠিকাদার সকল দায়যুক্ত বীমা

৩. কন্ট্রাক্টর’স প্লান্ট এন্ড ইকুয়িপমেন্ট বা ঠিকাদার কর্তৃক ব্যবহৃত যন্ত্রপাতি বীমা

৪. ইরেকশন অল রিস্ক বা উত্তোলন সকল দায়যুক্ত বীমা

৫. মেশিনারী ব্রেকডাউন বা যন্ত্রপাতি বিকল/অনিষ্ঠতা বীমা

৬. যন্ত্রপাতি অনিষ্টতার কারণে পরিণতিজনিত কারণে ক্ষতি

৭. ইলেকট্রনিক্স ইকুয়িপমেন্ট বীমা

৮. ডিটেরিওরেশন অফ ষ্টক বা (কোল্ড ষ্টোরে খাদ্য পঁচনজনিত বীমা)

৯. রকেট বা স্যাটেলাইট বীমা (এই তালিকায় সর্বশেষ সংযোজন)

কারিগরী বীমায় যন্ত্রপাতির মূল্যায়ন:

কারিগরী বীমা যেমন- কন্ট্রাক্টর’স প্লান্ট এন্ড ইকুয়িপমেন্ট বীমা, মেশিনারী ব্রেকডাউন ইত্যাদি বীমায় যন্ত্রপাতির মূল্যায়ন “নিউ রিইন্সটেটমেন্ট ভ্যালু” বা নূতন পুনঃপ্রতিষ্ঠার মূল্য'র উপর নির্ভরশীল।

যন্ত্রপাতি ক্ষতির বেলায় দাবী নিষ্পত্তির পদ্ধতি:

১.  সম্পূর্ণ ক্ষতিগ্রস্থ বা ধ্বংসের বেলায়: যন্ত্রপাতির বর্তমান বাজার মূল্য পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়। এই পদ্ধতি যন্ত্রপাতির ক্ষতির পূর্ব বাজার মূল্যের উপর নির্ভরশীল। এতে যন্ত্রপাতির ব্যবহার জনিত স্বাভাবিক ক্ষয়, মূল্য হ্রাস ইত্যাদি বিবেচনা করা হয়। এ ব্যাপারে মোটরগাড়ি বীমার সাথে কারিগরী বীমার যথেষ্ট সাদৃশ্য রয়েছে।

২. যন্ত্রাংশ ক্ষতির বেলায়: ক্ষতিগ্রস্থ যন্ত্রাংশ মেরামত বা পুরনো ব্যবহৃত যন্ত্রাংশের পরিবর্তে নূতন যন্ত্রাংশ সরবরাহ করা হয়।

প্রযুক্তি এবং কারিগরী বিদ্যার উন্নয়নের সাথে সাথে কারিগরী বীমার প্রয়োজনীয়তা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। পৃথিবীর উন্নয়নশীল দেশগুলিতে কারিগরী বীমার ব্যবহার ব্যাপক। ঠিকাদার সকল দায়যুক্ত বীমা ছাড়া পদ্মা সেতুর মত বৃহৎ এবং ব্যয়বহুল প্রকল্পের নির্মাণ কাজ চিন্তা করা যায় না। সরকারী পর্যায়ে রাস্তাঘাট নির্মাণ, বাঁধ নির্মাণ, ভূ-গর্ভস্থ সুরঙ্গ বা টানেল নির্মাণ ইত্যাদির বেলায় বাধ্যতামূলকভাবে ঠিকাদার সকল দায়যুক্ত বীমার ব্যবস্থা করা প্রয়োজন।

বেসরকারী পর্যায়ে উচ্চ দালান কোঠা/টাওয়ার ইত্যাদি নির্মাণের বেলায় এই বীমা বাধ্যতামূলক করা প্রয়োজন। এতে করে বীমা কোম্পানীর প্রিমিয়াম আয় বৃদ্ধির সাথে সাথে সরকারের রাজস্ব আয়ও বৃদ্ধি পাবে।

বাংলাদেশে সকল প্রকার কারিগরী বীমা ব্যবহারের যথেষ্ট সুযোগ রয়েছে বর্তমানে যার ব্যবহার অতি সামান্য বা সীমিত।

লেখক: এ কে এম এহসানুল হক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক ডিগ্রিসহ মাস্টার্স ডিগ্রি অর্জন করেছেন। প্রায় চার দশক দুবাইয়ে অবস্থানকালে তিনি আন্তর্জাতিক খ্যাতি সম্পন্ন বিভিন্ন বীমা কোম্পানিতে চাকরি করেছেন।

এ সময় তিনি লন্ডন থেকে ফেলো অফ দি চাটার্ড ইন্স্যুরেন্স ইন্সটিটিউট (এফসিআইআই), এসোসিয়েটস অফ দি ইন্সটিটিউট অফ রিস্ক ম্যানেজমেন্ট (এআইআরএম) এবং এসোসিয়েট অফ দি চাটার্ড ইন্সটিটিউট অফ আরবিট্রেটরস (এসিআইআরবি) ডিগ্রি অর্জন করেন।

ইন্স্যুরেন্সের ওপর এ পর্যন্ত লেখকের অনেকগুলো বই প্রকাশিত হয়েছে, যা দেশে এবং বিদেশে সমাদৃত। পেশায় লেখক একজন চাটার্ড ইন্স্যুরার। বর্তমানে তিনি সরকারী ও বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতায় নিয়োজিত।

ইন্স্যুরেন্সনিউজবিডি'র পাঠকদের প্রয়োজনের দিকে লক্ষ্য রেখে বীমার গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো নিয়ে লিখেছেন এ কে এম এহসানুল হক।